গোজওয়া একরকম জাতীয় ক্রীড়া। এই ক্রীড়ার বিধান অনুসারে একান্ত প্রয়োজন না হলে রক্তপাত নিষিদ্ধ। পরিবারে খানেওয়ালার সংখ্যা কমিয়ে রাখার কাজে গোজওয়া খানিকটা সাহায্য করে। তবে এতে খাদ্যবস্তুর মোট পরিমাণ বাড়ে না। দুর্বল কওম অথবা স্থায়ী-বসুয়া কওম অনেক সময় প্রবল প্রতিবেশী কওমকে খাজনা দিয়ে নিরাপত্তা খরিদ করে।
গোজওয়ার অপকারিতা খানিটা প্রশমিত হয় আতিথেয়তার নীতি দ্বারা। দুশমন হিসেবে বেদুঈন যত নির্মমই হোক না কেন, তার বন্ধুত্বের নিয়মের মধ্যে সে একান্ত বিশ্বস্ত ও পরম উদার। প্রাক-ইসলামী যুগে কবিরাই ছিল বড় সাংবাদিক। তারা মেহমানদারীর প্রশংসা কীর্তনে কখনো ক্লান্ত হয় নাই। তারা বলত : মেহমানদারী, ধৈর্য ও মরদামী–এই-ই তো জাতির শ্রেষ্ঠ গুণ। পানি ও ঘাসের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার ফলেই কওমেরা পরস্পর দুশমন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দুর্দমনীয় হিংস্র মরু-প্রকৃতির সামনে মানুষ যে কত অসহায়, এরই উপলব্ধি হতে উদ্ভূত হয় এক পবিত্র কর্তব্য-জ্ঞান-মেহমানদারীর মহান দায়িত্ব। মরুভূমিতে সরাইখানা নাই, হোটেল নাই। সেখানে কোন মুসাফিরকে আশ্রয়দানে অস্বীকার কেবল সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি ও ইজ্জতের হানিকর স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধ কাজ। কারণ, তিনি সকল আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয়দাতা।
কওমী সংগঠন হচ্ছে বেদুঈন সমাজের বুনিয়াদ। একটি তাঁবু মানে একটি পরিবার। একসঙ্গে যতগুলি তবু থাকে, তা নিয় হয় একটি কওম। কয়েকটি আত্মীয় কওম নিয়ে হয় একটি সম্প্রদায়। এক কওমের লোক প্রত্যেক প্রত্যেককে এক রক্তের ভাই বলে মনে করে, এক শেখের আনুগত্য স্বীকার করে এবং এক যুদ্ধ-ধ্বনি করে। কওমের বয়োজ্যষ্ঠ জনকেই সাধারণত কওমের শেখ বা সর্দার করা হয়। গোত্রীয় সংগঠনে রক্তের সম্বন্ধ পরস্পরকে একত্রে বেঁধে রাখে । কোন কওমের এক ব্যক্তির কয়েক ফোঁটা রক্ত চুষে খেলেই সে কমে দাখিল হওয়া চলে।
তাঁবু এবং তাঁবুর ভিতর গিরস্থালীর জিনিষ-পাতি যা থাকে, তা তাঁবুপতির নিজ সম্পত্তি। কিন্তু পানি, ঘাস ও আবাদযোগ্য ভূমি কওমের সাধারণ সম্পত্তি।
কোন কওমে লোক যদি নিজ কওমের কোন লোককে খুন করে, তবে কেউ তার পক্ষে দাঁড়াবে না। যদি সে কওম ছেড়ে চলে যায়, তবে সে আইন বা সমাজ বিরোধী হয়ে পড়ে। যদি কওমের বাইরের কোন লোককে খুন করা হয়, তবে খুনের বদলা দিতে হয়। কওমের যে কোন লোককে নিজ জান দিয়ে সে বদলা দিতে হতে পারে।
মরুভূমির আদিম আইন অনুসারে রক্তের বদলা দিতে রক্ত চাই। প্রতিহিংসা সাধন ছাড়া আর কোন শাস্তিই পর্যাপ্ত নয়। রক্তের কলহ চল্লিশ বছর পর্যন্ত স্থায়ীও হতে পারে। প্রাক-ইসলামী যুগে কওমে কওমে যত লড়াই হয়েছে, তল্কালীন ঐতিহাসিকেরা রক্তের ঋণকে তার আসল কারণরূপে বর্ণনা করেছেন, যদিও অর্থনৈতিক বিবেচনাও নিঃসন্দেহভাবে অনেক লড়াই’র কারণ ছিল।
নিজ কওমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার চেয়ে বড় বিপদ বেদুঈনের জীবনে আর নাই। কারণ, কওমহীন মানুষ কার্যতঃ অসহায় হয়ে পড়ে। তার অবস্থা আইনের আশ্রয়চ্যুত ব্যক্তির অবস্থার মতো–সে আশ্রয় ও নিরাপত্তার সীমার বাইরে চলে যায়।
কওমী জীবন চায় সহযোগী কওমী মানুষের প্রতি শর্তহীন অসীম বিশ্বস্ততা। সে আনুগত্য দানের সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নেয় যে, তার কওম এক স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ ইউনিট। সে বিশ্বাস করে, অন্য প্রত্যেক কওমকে তার লুণ্ঠন ও হত্যা করার সঙ্গত অধিকার আছে। সামরিক ব্যাপারে ইসলাম এ-সব কওমের শক্তি ও দলীয় ঐক্যবোধের সদ্ব্যবহার করেছিল। ইসলাম তার সৈন্যদলকে কওমে কওমে বিভক্ত করত বিজিত দেশে কওমী ভিত্তিতে উপনিবেশ স্থাপনের ব্যবস্থা করত এবং পরাজিত জাতিসমূহের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করত, তাদের আশ্রিত বলে গণ্য করত। ইসলামের অভ্যুদয়ের পর আরব-চরিত্রের ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশ সাধিত হয়েছিল। কিন্তু সে চরিত্র এই কওমী মেজাজ এবং আত্মকেন্দ্রিক জীবনের সমাজবিরোধী বৈশিষ্ট্যসমূহকে সম্পূর্ণরূপে জয় করতে পারে নাই এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের অবনতি ও পতনের এই-ই কারণ ছিল।
কওমের সর্দারকে বলা হয় শেখ। শেখই কওমের প্রতিনিধি। শেখ কওমের বয়োজ্যষ্ঠ ব্যক্তি। তার নেতৃত্ব নির্ভর করে সংযত বিচার-বুদ্ধি, উদারতা ও সাহসিকতার উপর। বিচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং জনসাধরণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাপারে শেখ সর্বময় কর্তা নন-কওমের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন পরিবারের কর্তাদের নিয়ে গঠিত পরামর্শ-সভার সঙ্গে তাকে আলোচনা করতে হয়। শেখের পদের স্থায়িত্ব নির্ভর করে কওমের সদিচ্ছার উপর।
আরব–বিশেষ করে বেদুঈন, জন্ম-গণতন্ত্রী। সে সমান স্তরে দাঁড়িয়ে শেখের সঙ্গে কথা কয়। যে সমাজে তার বাস, সে সমাজ প্রত্যেককে সমান স্তরে নামিয়ে আনে। বর্তমান কালের আগে বিদেশী শাসকদের ছাড়া আর কাউকে আরবরা কখনো মালিক বলে সম্বোধন করে নাই। কিন্তু আরব যেমন গণতন্ত্রী তেমনি আবার আভিজাত্য-প্রিয়। সে নিজকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ গুণান্বিত জীব বলে মনে করে। তার কাছে আরব জাতির মত মহৎ জাতি এ দুনিয়ায় আর নাই। বেদুঈন পরম গর্বের সঙ্গে বিশ্বাস করে যে, সভ্য মানুষ কম সুখী ও অতি নিকৃষ্ট। তার রক্তের পরিবত্রতায়, বাগীতায় এবং কবিত্বে, তার ঘোড়া ও তলোয়ারে সর্বোপরি তার মহান বংশ-মর্যাদায় আরবের গর্বের অন্ত নাই। সে সুদীর্ঘ বংশ-তালিকার কথা আওড়াতে ভালোবাসে এবং অনেক সময়, তার পূর্বপুরুষদের আদম পর্যন্ত নিয়ে ঠেকায়।