.
পরিশিষ্ট
স্যার ফিলিপ কে. হিট্টির জগদ্বিখ্যাত বই The History of the Arabs. এটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে আরব জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংক্রান্ত প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে এর মূল্য অপরিসীম। পঞ্চাশের দশকে হিট্টির এই বৃহৎ গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত (abridged) সংস্করণ প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক থেকে। ইবরাহীম খাঁ সেই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটির বাংলা অনুবাদ করেন। আরব জাতির ইতিহাস শিরোনামে তা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালের জানুয়ারী মাসে। ঢাকস্থ ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকশন্সের সহযোগিতায় ইসলামিক একাডেমীর পক্ষে মুহিউদ্দীন খান, আশ্বিনপুর, নায়েব গাঁ ত্রিপুরা (ঢাকা অফিস ১৫, কোর্ট হাউস স্ট্রীট, ঢাকা) হতে প্রকাশিত এবং মুহম্মদ হোসেন, দি স্টার প্রেস, ২১/১ শেখ সাহেব বাজার লেন ঢাকা থেকে মুদ্রিত। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ + ২১৫। মূল্য চার টাকা।
হিট্টির ইতিহাস অনেকটা কাব্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক ভাষায় লিখিত। ইবরাহীম খাঁ অনুবাদে সে মেজাজ অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। আবার এদেশীয় স্বল্পশিক্ষিত মুসলমান পাঠকের বোধগম্যকরণের দিকেও ছিল তার সচেতন দৃষ্টি। ফলে এটি একটি অনবদ্য অনুবাদে পরিণত হয়।
.
জীবনপঞ্জি
নাম : ইবরাহীম খাঁ। ডাকনাম খাজা বা খাজা মিয়া। খাজা ছদ্মনামে তাঁর বেশ কিছু রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ নামেই পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
জন্ম : ১৮৯৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে ‘এক বৃহস্পতিবার বার বেলা’য় বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুর থানার অন্তর্গত বিরামদী (বর্তমানে শাবাজনগর) গ্রামে ইবরাহীম খাঁ জন্মগ্রহণ করেন। পিংনা হাইস্কুলের ভর্তি রেজিস্ট্রারে তার জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে ১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫। বংশ : টাঙ্গাইল শহরের মাইল সাতেক পূর্ব-দক্ষিণে বাসাইল গ্রামে পাঠান বংশের কয়েক গোষ্ঠী খাঁ পরিবার বাস করতেন। এঁরা ইবরাহীম খাঁর পূর্বপুরুষ। তাঁর ছ পুরুষ আগে এ বংশের দুভাই বিরামদীর পাশে ফশলান্দী গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। ইবরাহীম খাঁর পিতা শাবাজ খাঁ থেকে বিরামদী গ্রামে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত। মাতা রতন খানম। ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ–(১) আবদুল করীম খ, (২) শাহে বানু, (৩) আবদুস সোবহান খাঁ, (৪) কাজিম উদ্দীন খাঁ, (৫) এবাদত আলী খাঁ, (৬) ইবরাহীম খাঁ ও (৭) লুৎফর রহমান খাঁ।
শিক্ষা : বাড়িতে বড় ভাইয়ের কাছে বাংলা, মুনশির কাছে আরবি পড়ায় ইবরাহীম খাঁর হাতেখড়ি। ফশলান্দীর পাঠশালা থেকে নিম্ন প্রাইমারী এবং লোকের পাড়া পাঠশালা থেকে উচ্চ প্রাইমারি পাস। ১৯০৬ সালে হেমনগর হাইস্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাসের পর ১৯০৭ সালে পিংনা হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ঐ স্কুল হতে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন ১৯১২ সালে। তিনি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ হতে ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আই. এ. এবং ১৯১৬ সালে কলিকাতার সেন্ট পলস্ কলেজ হতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ বি. এ. পাস করেন। ১৯১৭ সালে আইনের প্রিলিমিনারী, ১৯১৮ সালে ল-ইন্টার, ১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে প্রাইভেট এম. এ. এবং ১৯২৩ সালে আইন পাস করেন।
সংসার : ১৯১৭ সালের ১ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বড় বাশালিয়া গ্রামের রঈছ মমতাজউদ্দীন খাঁ ওরফে নয়ামিয়ার কনিষ্ঠা কন্যা আনজুমান নেছার সঙ্গে ইবরাহীম খাঁর বিয়ে হয়। তাদের প্রথম সন্তান শামসুজ্জামান খাঁ দুলামিয়া আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়ার সময় মারা যান। দ্বিতীয় পুত্র মরহুম আসাদুজ্জামান খাঁ সুজা মিয়া বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ-এর শ্বশুর। একমাত্র কন্যা বেগম খালেদা হাবিব সমাজসেবী এবং শিক্ষাবিদ। কাকলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তৃতীয় পুত্র আমিনুজ্জামান খা (আমিন) ভূয়াপুর থানা (উপজেলা) পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, বর্তমানে বিলেতে বসবাসরত। ১৯৭৬ সালের ১১ নভেম্বর ইবরাহীম খাঁর স্ত্রী মারা যান।
কর্ম : ১৯১৯ সালের ২৮ নভেম্বর ইবরাহীম খাঁ করটিয়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। ১৯২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষকতা ত্যাগ করে তিনি ময়মনসিংহ শহরে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন। ১৯২৫ সাল অবধি ওকালতি ব্যবসায় থাকার পর ১৯২৬ সালের ২ জানুয়ারি পুনরায় হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকপদে যোগ দেন এবং আটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়ার সৌজন্যে সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন। ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর প্রিন্সিপাল হন এবং একটানা ২২ বছর ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আসাম ও অবিভক্ত বাংলায় সা’দত কলেজ মুসলমান প্রতিষ্ঠিত প্রথম কলেজ এবং ইবরাহীম খাঁ ছিলেন প্রথম মুসলমান প্রিন্সিপাল। ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর সরকারের আমন্ত্রণে তিনি পূর্ববাংলা মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৩ সালের ১৪ জুলাই অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ভূয়াপুর কলেজ (বর্তমানে ইবরাহীম খাঁ মহাবিদ্যালয়) এবং পরবর্তীকালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের সহযোগিতায় বাংলা কলেজ (বর্তমানে ঢাকায় মীরপুরস্থ সরকারি বাংলা কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ; সাধারণ সম্পাদক ইবরাহীম খাঁ এবং অধ্যক্ষ প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক শিক্ষক সমিতিরি সভাপতি ছিলেন ইবরাহীম খাঁ। তিনি ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায়, পাকিস্তান গণপরিষদে এবং ১৯৬২ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ তারিখে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তিনি দলীয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তান কৃষি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে, কলিকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে এবং বাংলা একাডেমীর প্রথম দুই কার্যনির্বাহী পরিষদে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তিনি আন্তপার্লামেন্টারী মত বিনিময় কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও চীন সফর করেন। তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন।