পাশ্চাত্য জগত হতে যে সব নতুন ভাবধারা প্রাচ্যে আমদানী হয়, তার মধ্যে জাতীয়তা ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। জাতীয়তার আদর্শকে বরণ করে নেওয়ার ফলেই শুরু হয় স্বাধীনতা-সংগ্রাম এবং ফলে অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্র অনেকাংশে ছিন্ন হয়ে যায়।
আরব জাতীয়তার জাগরণের আরম্ভ ছিল সম্পূর্ণ জ্ঞানাত্মক আন্দোলন হিসেবে। যারা এ জাগরণের অগ্রদূত, তারা বেশীরভাগই ছিলেন সিরিয়ার বুদ্ধিজীবী–বিশেষ করে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত লেবানীজ খৃস্টান। এরা মিসরে বসে আন্দোলন পরিচালনা করতেন। এ আন্দোলনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ছিল প্রাচীন আরবী সাহিত্যের চর্চা এবং ইসলামী ইতিহাসের গবেষণা। আরব সাম্রাজ্যের অতীত গৌরব-মহিমা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরব জাতির অতীত কীর্তি ও অবদান–এসবের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে শিক্ষিত মহলের চিত্তে এক গর্বিত চাঞ্চল্যের সঞ্চার হয়। পিছনের দিকে চেয়ে তারা সামনের দিকে চাইতে শিখে। জ্ঞানাত্মক জাগরণের পরেই আসে রাজনৈতিক জাগরণ এবং একটা পুনর্জীবিত ও পুনর্মিলিত আরব-সমাজের জন্য উদগ্র আকা বহুজনের বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অবসাদের স্থানে রাজনৈতিক কর্ম-চাঞ্চল্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ আরব জাতীয়তার ভিত্তি-ভূমি ব্যাপক। এর মূলনীতি এই যে, ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত আরব ভাষাভাষী জাতি এক : তারা এক ভাষা এবং এক সাধারণ সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ। এ প্রচেষ্টা এগিয়ে চলে প্যান-ইসলামের পথে নয়–প্যান-আরবত্বের পথে। এ আন্দোলনের অগ্রগমনের পথে জটিল স্থানীয় সমস্যা এসে সামনে দাঁড়ায়; ফলে আন্দোলন মূল পথ হতে সরে আসে। মিসরে এ আন্দোলনের পথে প্রথম বিরাট বাধারূপে এসে উপস্থিত হয়, ১৮৮২ সালে ইংরেজের মিসর অধিকার। অতঃপর বৃটিশ শাসনের বিরোধিতাতেই মিসরের উৎসাহ-উদ্দীপনা নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে। এই সময় হতেই মিসরীয় জাতীয়তাবাদ প্যান-আরবত্ব হতে ভিন্ন পথে চলতে শুরু করে। মিসরীয় আন্দোলনে আঞ্চলিক এবং স্থানীয় স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে। আধুনিক যুগে মিসরবাসী এই প্রথম উপলব্ধি করে যে, সে মিসরীয়। “মিসর মিসরীয়দের জন্য এই হয়ে দাঁড়ায় সগ্রাম-ধ্বনি।
প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে আরব-জগত আরো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, আরব জাতীয়তাবাদও আরো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সিরিয়াতে এর শক্তি প্রথম নিয়োজিত হয় তুর্কীকরণ নীতির বিরুদ্ধে; সিরিয়ার ঘাড়ে ফরাসী অছি শাসন চাপিয়ে দেওয়া পর এ-শক্তি নিয়োজিত হয় ফরাসী-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। এইরূপে ফিলিস্তিনে স্থানীয় জাতীয়তার শক্তি প্রথম প্রযুক্ত হয় বৃটিশ অছিগিরির বিরুদ্ধে; তারপর প্রযুক্ত হয় ইসরাইলের বিরুদ্ধে। লেবানন প্রথমে অছি-শাসনের পক্ষে ছিল; পরে এর তীব্র বিরোধিতা করে পূর্ণ আজাদী অর্জন করে। লেবানন ও সিরিয়ার বুক হতে অছিবাদের শাসনের শেষ চিহ্ন মুছে ফেলা হয় ১৯৪৩ ও ১৯৪৫-এর মধ্যে। আরব অর্ধচন্দ্রের পূর্ব শৃঙ্গে ১৯২০ সালের দিকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদিতার বিরুদ্ধে এক ইরাকী জাতীয়তা গড়ে ওঠে। ক্ষুদ্র ট্রান্সজর্দান ইতিপূর্বে কোন কালেই স্বাধীন ছিল না; ইংরেজরা এ জনপদকে ১৯২১ সালে সিরিয়া হতে ছিন্ন করে এনে আমীর আবদুল্লহর অধীন এক স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিণত করে।
এইরূপে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আরব-অঞ্চলসমূহ দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে স্বতন্ত্র জাতি বা উপজাতি গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং ইহুদীবাদের অভ্যুদয় এই বিচ্ছিন্ন অংশসমূহকে আবার একত্র হওয়ায় সাহায্য করে। ফিলিস্তিনে ইহুদীবাদের প্রতিষ্ঠাকে আরবরা সর্বত্রই অন্যায় অনুপ্রবেশ মনে করে আসছে। সাধারণ স্বার্থের তাগিদ এবং ক্রমবর্ধমান সংহতি-বোধ চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করেছে আরব-লীগের সংগঠনে। ১৯৪৫ সালে কায়রোতে এই ঐক্য-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আরব-লীগের বর্তমান সদস্য সংখ্যা দশ; মিসর, ইরাক, সউদী আরব, ইয়ামন, লেবানন, সিরিয়া, জর্দান, লিবীয়া, মরক্কো এবং সুদান। শাসন-ব্যবস্থার দিক দিয়ে এ মধ্যে ইরাক*, জর্দান এবং লিবীয়া নির্বাচনভিত্তিক পার্লামেন্ট সহ নিয়মানুগ রাজতন্ত্র; মিসর, সিরিয়া এবং লেবানন রিপাবৃলিক। এ সমস্ত রাষ্ট্রই এখন জাতিসংঘের সদস্য এবং বেশীর ভাগেরই লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীতে কূটনৈতিক প্রতিনিধি আছে।
তৃতীয় একেশ্বরবাদমূলক ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা–ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে পূর্ববর্তী ধর্ম দুটির অবদান ভাগী, প্রতীচ্যের সঙ্গে গ্রীকো-রোমান ঐতিহ্যের অংশীদার, সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী মুক্ত-জ্ঞানের মশালধারী, ইউরোপীয় রেনেসাঁর মহানুভব দাতা-আরবী-ভাষী জাতিরা এসবই ছিল। মাঝখানে তারা পেছনে পড়ে গিয়েছিল। এবার তারা জগতের অগ্রগমন-রত গণতান্ত্রিক জাতিসমূহের মধ্যে স্থান গ্রহণ করেছে। আমরা আশান্বিত হৃদয়ে ভাবছি : আবার তাদের অবদানে বিশ্বের প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ সুগমতর হয়ে উঠেবে।
———
* সম্প্রতি (১৪ জুলাই, ১৯৫৮) এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে ইরাকের বাদশাহ্ ফয়সল নিহত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে ইরাকে রাজতন্ত্রের অবসান ঘোষণা করা হয়।