এসব দেশের মধ্যে মিসরই সর্বাগ্রে নব-জীবনের চাঞ্চল্য অনুভব করে। সাড়াটা আসে পশ্চিম থেকে উপলক্ষ ছিল ১৭৯৮ সালের নেপোলিয়নের আক্রমণ। ফরাসী বিজেতা ভ্যাটিকান থেকে একটা আরবী প্রেস লুণ্ঠন করেছিলেন; মিসর অভিযানকালে তিনি অন্যান্য উপকরণের মধ্যে এই প্ৰেসখানি সঙ্গে আনেন এবং তাঁর নিজের পণ্ডিতদের সমবায়ে ও সহযোগিতায় একটি সাহিত্য-সংস্থা গঠন করেন। নীলনদের উপত্যকায় উপরোক্ত প্ৰেসখানিই ছিল সর্বপ্রথম মুদ্রা-যন্ত্র। ক্রমে—’বুলাগ ছাপাখানা’ নামে এর যথেষ্ট উন্নতি হয়। আজো এ প্রতিষ্ঠানটি বেঁচে আছে।
নেপোলিয়নের পরে আসেন তধুনিক মিসরের জন্মদাতা মুহম্মদ আলী। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এই অবিচ্ছিন্ন সাক্ষাতের মধ্যে ভবিষ্যতের বিরাট সম্ভাবনা উপলব্ধি করে তিনি এগিয়ে চলতে সংকল্প করেন। তিনি ইউরোপে বিভিন্ন ছাত্র মিশন পাঠান এবং তাঁর দেশের অফিসার ও বিদ্বান ব্যক্তিদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য ইউরোপীয়–বিশেষ করে ফরাসী মিশন দাওয়াত করে আনেন।
১৮৩১ সালে যখন মুহম্মদ আলী তাঁর আরব-সাম্রাজ্যের স্বপ্ন সফল করার উদ্দেশ্যে সিরিয়া বিজয়ের জন্য অভিযান করেন, তখন তিনি ভূমধ্যসাগরের সমস্ত পূর্ব সীমান্তে পশ্চিম ইউরোপীয় সাংস্কৃতির প্রভাবের প্রবেশ-পথ উন্মুক্ত করে দেন। এই সময়ে প্রটেস্টেন্ট মিশনারীরা প্রধানতঃ আমেরিকান–দলে দলে এসে এসব অঞ্চলে স্থায়ীভাবে কাজ শুরু করেন। লেবাননের বর্তমান রাজধানী বৈরুতে ১৮৩৪ সালে আমেরিকান প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। সাবেক সিরিয়ায় এই-ই ছিল প্রথম উন্নত-ধরনের প্রেস। তিন বছর পর স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রটেসটেন্ট গীর্জা সংগঠিত হয়। অনেক দিন পর জেসুইট সম্প্রদায়ের খৃস্টান পাদ্রীরাও এই সময় লেবাননে ফিরে আসেন। ১৮৫৩ সালে বৈরুতে তাদের ইমপ্রিমেরী ক্যাথলিক স্থাপিত হয়। দুটি প্রেসই এখনো চালু আছে; সাজসরঞ্জামে এগুলি অতি উন্নতমানের প্রেস। আধুনিক আরবীতে বাইবেলের দুটি অনুবাদ এই ছাপাখানা দুটি হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। আরবীতে বহুসংখ্যক ইংরাজী ও ফরাসী গ্রন্থের অনুবাদ হয় এবং সে সব তরজমা লোক-প্রিয় হয়ে ওঠে। আমেরিকান মিশনারীরা অবশেষে ১৮৬৬ সালে সিরীয় প্রটেসৃটেন্ট কলেজ স্থাপন করেন; বর্তমান ‘বৈরুত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়’ এই কলেজেরই রূপান্তরিত পর্যায়। আট বছর পর শহরের অপর প্রান্তে ‘সেন্ট জোসেফ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলে শিক্ষাদান ক্ষেত্রে এই দুটি প্রতিষ্ঠানই নেতৃত্বের স্থান অধিকার করে আছে। ইতিমধ্যে বিশেষ করে লেবাননে স্থানীয় লোকের দ্বারা অসংখ্য স্কুল, ছাপাখানা, খবরের কাগজ, মাসিক কাগজ এবং সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমুদ্রতীরবর্তী এই পার্বত্য অঞ্চলকে সুদূর অতীতের ফিনিশীয়, রোমক ও বাইজেন্টাইন আমল হতে পাশ্চাত্য অভিমুখী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ফখরুদ্দীন-আল-মানী (১৫৯০–১৬৩৫) এবং বশীরুল শিহাবী (১৭৮৬ ১৮৪০) লেবাননের দুই কৃতী সন্তান ছিলেন। এদের অধীনে লেবানন ওসমানীয় শাসন হতে অর্ধ স্বাধীনতা লাভ করে। ইটালীয়, ফরাসী ও বৃটিশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে এই সময় লেবাননের ঘনিষ্ঠতর সংযোগ ঘটে। মুহম্মদ আলীর বহু আগে ফখরুদ্দীন ইউরোপীয়–বিশেষ করে ফ্রান্স ও ফ্লোরেন্সের সওদাগরগণকে লেবাননের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্বন্ধ স্থাপন করতে উৎসাহিত করেন এবং টাসূকেনী হতে কৃষি মিশন দাওয়াত করে আনেন। তিনি এবং বশীর উভয়ই তুর্ক সুলতান কর্তৃক স্বদেশ হতে নির্বাসিত হন এবং ইস্তাম্বুলে ইন্তিকাল করেন। ফখরুদ্দীনকে হত্যা করা হয়।
তুর্ক শাসকদের উস্কানীতে দ্রুজ ও ম্যারোনাইটদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয় এবং সেই অজুহাতে ১৮৬০ সালে তুর্ক কর্তৃপক্ষের আদেশে এক নির্মম নরহত্যার অনুষ্ঠান হয়। তখন ইউরোপীয় শক্তিপুঞ্জ মিলে লেবাননকে স্বায়ত্ত শাসন দিতে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সেই নিশ্চয়তার ফলে একজন খৃস্টান গভর্নর লেবানন শাসন করতে থাকেন। স্বায়ত্তশাসনের এই ব্যবস্থার ফলে পশ্চিম ইউরোপ হতে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে নব নব, ভাব ও সে ভাবের প্রয়োগ-জ্ঞান দেশে আসতে শুরু হয়। পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দারা বেশীর ভাগই খৃস্টান থাকায় তারা নতুন ভাবধারা গ্রহণে অধিকতর উৎসুক ছিল। তাদের পূর্বপুরুষদের মত তাদের সন্তানেরা অনেকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সভ্য জগতের বিভিন্ন অংশে গিয়ে বসবাস শুরু করে। এদের কাছে বিশেষ প্রিয় ছিল আমেরিকা। লেবানন ও সিরিয়ার এই ঔপনিবেশিকেরা আমেরিকা হতে তাদের পুরোনো বাসভূমিতে নব ভাব প্রেরণের জন্য নতুন পথ সৃষ্টি করে। সুতরাং, অল্পকালের মধ্যেই আধুনিকায়ন ও ধর্ম-নিরপেক্ষ ব্যবস্থার রূপায়ণের ব্যাপারে লেবানন তার প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রাচ্যের উপর পাশ্চাত্যের এই অভিঘাত আধুনিক ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ ব্যাপার। পুরাতন সমাজ ভেঙ্গে তার স্থলে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আর সেই দ্রুত ক্রমবিকাশেরই অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে সামাজিক, আর্থিক, ধর্মীয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। নতুন জীবন-ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি স্থাপনের জন্য আজও অনেক সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।