আরব দেশসমূহের মধ্যে আলজিরীয়াকে সর্বাগ্রে তুর্ক সাম্রাজ্য হতে খসিয়ে নেওয়া হয়। ১৮৩০ সালে এদেশ ফ্রান্স দখল করে এবং পরে একে ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৮৮১ সালে তিউনিসীয়া ফ্রান্সের কবলে আসে। ১৯১২ সাল পর্যন্ত ইউরোপের তিনটি ল্যাটিন শক্তি ফ্রান্স, স্পেন ও ইটালী মরক্কো হতে লিবীয়া পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। সমগ্র উত্তর আফ্রিকা সবার আগে আরব মুসলিম-জগত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশ্চাত্য প্রভাবের অধীন হয়; এ ভূভাগ মুসলিম-জগতের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত; এর বাসিন্দাদের মধ্যে অনারবের সংখ্যা প্রচুর ছিল। এই সমস্ত কারণ হেতু এ ভূভাগের বাসিন্দারা জাতীয়তা হারিয়ে স্বতন্ত্র পথে চলে। পশ্চিম এশিয়া এবং মিসরই প্রকৃতপক্ষে ইসলামের হৃদয় এবং কেন্দ্রভূমি। ভূগোলের দিক দিয়ে মিসর আফ্রিকার একাংশ হলেও ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে একে পশ্চিমে এশিয়ার অঙ্গ মনে করা যেতে পারে।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগ পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়া ও মিসরসহ এই বিশাল ভূখণ্ড নামে বা প্রকৃতপক্ষে তুর্ক-সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৮৮২ সাল হতে মিসর ইংরেজদের কবলে ছিল; এই মহাযুদ্ধকালে মিসর তুরস্কের শেষ বন্ধন ছিন্ন করে। এই সুযোগ মক্কার শরীফ হোসেনও তুর্কদের অধীনতা অস্বীকার করে বসেন। তিনি মহানবীর অন্যতম অধঃস্তন পুরুষ ছিলেন। তিনি মক্কাকে কেন্দ্র করে নতুন খিলাফত স্থাপন করে নিজেই খলীফা পদে সমাসীন হবেন–এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে অন্যান্য আরবগণকে বিদ্রোহী হতে উৎসাহ দেন। ১৯২৪ সালে যখন মুস্তফা কামাল তুর্ক-খিলাফতের বিলোপ সাধন করেন, তখন এই আরব রাজা” নিজেকে মুসলমানদের খলীফা ঘোষণা করেন। তুর্ক-সাম্রাজ্য হতে খসে এনে আধুনিক আরব-সাম্রাজ্য স্থাপনের এ ছিল দ্বিতীয় চেষ্টা। এর আগের শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের মধ্যে মিসরের রাজ-প্রতিনিধি মুহম্মদ আলী প্রথম এমনি একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ দেড়শ’ বছর টিকে থাকে। দুটি চেষ্টাই উপযুক্ত সময়ের আগে করা হয়। জনসাধারণের রাজনৈতিক চেতনার উপর এর বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তাছাড়া, এ উভয় চেষ্টা নিকট প্রাচ্যে বৃটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির স্বার্থের বিরোধী ছিল । শেষ পর্যন্ত শরীফ হোসেন নিজ পৈত্রিক রাজ্য হতেও ইবনে সউদ কর্তৃক বিতাড়িত হন। ইবনে সউদ নজ্বদের রক্ষণশীল ওয়াহ্হাবীদের বিজ্ঞ ও সুদক্ষ নেতা ছিলেন। ১৯০০ হতে ১৯২৫ সালের মধ্যে এই সুচতুর মরু-নেতা পারস্য উপসাগর হতে লাহিত সাগর পর্যন্ত সুবিস্তৃত একটি রাজ্য গড়ে তোলেন। মহানবীর পর আরব উপদ্বীপে এত বড় রাজ্য আর কেউ স্থাপন করতে পারে নাই। ১৯৩২ সালে সউদী আরব’ নামে এ রাজ্যের নাম বিঘোষিত হয়। সউদী আরবের লাগ দক্ষিণে ইয়ামন অবস্থিত। ইয়ামনের ধর্মীয় শাসনকর্তা ইমাম ইয়াহীয়া প্রথম মহাযুদ্ধ কালে নিজ দেশকে তুরস্কের অধীনতা হতে মুক্ত করেন। প্রাসাদ-চক্রান্ত ও পারিবারিক ষড়যন্ত্রের ফলে ইমাম ইয়াহীয়া ১৯৪৮ সালে নিহত হন। তার পুত্র সায়েফুল ইসলাম এখন ইয়ামনের সুলতান। এদিকে সউদী আরবের ইবনে সউদও ইন্তিকাল করেন ও তদস্থলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইবনে সউদ উপাধি গ্রহণ করে পিতার সিংহাসনে আসীন হন। বর্তমানে এই দ্বিতীয় ইবনে সউদ এবং সায়ফুল ইসলামই সমগ্র আরবে সম্পূর্ণ স্বাধীন শাসনকর্তা। উপদ্বীপের বাকী অংশ স্থানীয় শেখ ও সুলতানদের দ্বারা শাসিত হয়। এরা সবাই বৃটেনের সঙ্গে সন্ধি-সূত্রে আবদ্ধ। ইয়ামন এবং অনেকাংশে সউদী আরবও পাশ্চাত্য প্রভাবের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। দুনিয়া জোড়া আধুনিকতায়নের জোয়ার কি জানি কেমনে এদের উপকূল বাদ দিয়ে গেছে। বিগত সিকি শতাব্দী কালের মধ্যে সউদী আরব, কুয়ায়েত এবং বাহরায়েনে যে অপর্যাপ্ত তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং যে দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে খনিজ সম্পদ কাজে লাগান হচ্ছে তাতে এই সব স্থানের রাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত বেড়ে গেছে; আর সংশ্লিষ্ট দেশগুলিও অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর সিরিয়া ও লেবাননকে ফ্রান্সের অছি রাজ্যে পরিণত করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দুই দেশ ফরাসী গোলামীর জিঞ্জির ভাঙ্গতে পারে নাই। ফিলিস্তিনকে বৃটিশ অছি রাজ্যে পরিণত করা হয় এবং স্থানীয় অধিবাসীদের প্রবল আপত্তি ও প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলির বাধা দান সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনকে নিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। ট্রান্স-জর্দান বৃটিশ অছি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল; ১৯৪৬ সালে একে স্বাধীন বলে ঘোষণা করা হয়। এ রাজ্যের সুলতান হন শরীফ হোসেনের ছেলে এবং আমীর ফয়সলের বড় ভাই আবদুল্লাহ। আমীর ফয়সল কয়েক দিনের জন্য সিরিয়ার সিংহাসনে বসেন। পরে ফরাসীরা তাকে তাড়িয়ে দেয়; অতঃপর ১৯২১ সালে বৃটিশ-শক্তি তাঁকে নব সৃষ্ট রাষ্ট্র ইরাকের সিংহাসনে বসায়। অছি রাজ্যগুলির মধ্যে লেবাননই প্রথম নিজকে রিপাবলিক বলে ঘোষণা করে। ইরাক সংস্কৃতির দিক দিয়ে সিরিয়ার পেছনে থাকলেও সবার আগে অছি-রাজ্যের বন্ধন কেটে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৩০ সালে ইরাকের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় । ইংরেজের সঙ্গে একটা সন্ধি হয়, যেমন এর ছয় বছর পর মিসরও সন্ধি করে। এই সন্ধিসূত্রে ইংরেজকে স্বতন্ত্র সুবিধা দান করা হয়।