“হে প্রভু! তুমি আমাদের সুলতানকে রক্ষা করো : ইনি সুলতানের পুত্র সুলতান, উভয় মহাদেশ ও উভয় সমুদ্রের শাসক, উভয় বাহিনী উৎখাতকারী, উভয় ইরাক বিজেতা, উভয় পবিত্র শহরের খাদেম বিজয়ী ম্রাট সলীম শাহ্। হে প্রভু! তাঁকে তোমার অমূল্য সাহায্য মঞ্জুর কর। হে দো-জাহানের মালিক! তুমি তাঁকে গৌরবময় বিজয় লাভে সাহায্য কর।”
শেষ ক্রীড়নক খলীফা সত্যিই তাঁর খিলাফত-পদ তুর্ক সুলতানের নিকট হস্তান্তর করেছিলেন কিনা, তার যথেষ্ট প্রমাণ নাই। তবে তিনি সে পদ দিয়ে থাকুন আর না-ই থাকুন, এ কথা নিঃসন্দেহ যে, কন্সটানটিনোপলের তুর্ক ম্রাট ধীরে ধীরে খলীফা-পদের সমস্ত সুযোগ এবং অবশেষে খলীফা উপাধি আত্মস্থ করেন। সলীমের পরবর্তী সুলতানদের কেউ কেউ নিজেদের খলীফা বলে পরিচয় দিলেও এবং অন্যরা তাদের এই নামে সম্বোধন করলেও, তাদের খলীফা শব্দের ব্যবহার কেবল সম্মানসূচক ছিল এবং তাদের রাজ্যের বাইরে তারা খলীফা বলে স্বীকৃত হতেন না। ১৭৭৪ সালে সম্পাদিত রুশ-তুর্ক সন্ধি-পত্ৰই প্রথম জ্ঞাত আন্তঃরাষ্ট্রীয় দলীল, যাতে ওসমানীয় সুলতানকে খলীফা ও মুসলিম-জগতের ধর্মীয় নেতা বলে স্বীকার করা হয়েছে।
কন্সটানটিনোপলের সুলতান-খলীফা ইসলামের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী শাসনকর্তা হয়ে ওঠেন; কেবল বাগদাদের নয়, বাইজেন্টিয়ামের সম্রাটদেরও তিনি উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করেন। মামলুক-শক্তির পতন এবং বসফরাসের উপর ওসমানীয়দের আধিপত্য স্থাপনের ফলে ইসলামী শক্তির কেন্দ্র পশ্চিমে স্থানান্তরিত হয়। ঠিক এই সময়ই আমেরিকা ও উত্তমাশা অন্তরীপ আবিষ্কার এক নবযুগের সূচনা করে। আরব খিলাফতের ইতিহাস এবং আরব সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ হতে মধ্যযুগে যে সব মুসলিম বংশের অভ্যুদয় হয়, তাদের কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে। আরব-জগতে ওসমানীয় আধিপত্য শুরু হয়।
১৯. বর্তমান জগতে আরব-ভূমি
মধ্যযুগে অন্ধকারের রাজত্ব ছিল বটে, তবু সে যুগে আরব-ভূমির সামনে অন্ধকারের যবনিকা টেনে রাখে নাই কিন্তু আধুনিক যুগ তা করেছে। ১৫১৭ সাল হতে শুরু করে ওসমানীয় আধিপত্যের চারশ’ বছর পর্যন্ত আরব-প্রাচ্য বরাবর রাহু-গ্রস্ত থাকে। ওসমানীয় তুর্করা মুসলিম-জগতের একটি বিপুল শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। তারা কেবল আরব-ভূমিসমূহ জয় করে নাই, উপরন্তু ককেশাস হতে ভিয়েনার নগর দ্বার পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগের উপর তাদের বিজয়-বৈজয়ন্তী উড্ডীন করেছে–তাদের রাজধানী কন্সটানটিনোপল হতে তারা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের উপর আধিপত্য করেছে। এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চি ইউরোপীয় রাষ্ট্রনায়করা তাদের সমীহ করে চলেছে। ইতিমধ্যে অতীতের গৌরবোজ্জ্বল মদীনা, দামেস্ক, কায়রো বিস্মৃতির অতল তলে ডুবে যায়–অথচ একদা এগুলি পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য ও মহোজ্জ্বল সংস্কৃতি কেন্দ্রস্থল ছিল। এসব এখন কন্সটানটিনোপল হতে প্রেরিত প্রাদেশিক গভর্নরদের বাসস্থান ও সৈন্যদের কেল্লা হয়ে দাঁড়ায়। দামেস্ক ও বাগদাদের দুর্জয় বাহিনী অতীতে চার চার বার এই রাজধানী আক্রমণে উদ্যত হয়। এখন হতে এই শহরের উপর সকলের নজর পড়ে।
সুলতান-খলীফাদের সাম্রাজ্যে আরবদের ছাড়া নানা জাতির, নানা ভাষার, নানা ধর্মের আরো বহু শ্রেণীর লোকের বাস ছিল; একমাত্র তলোয়ারের জোরে এদের একত্রে রাখা হত। পরাজিত জাতিসমূহের সবারই এক ভাগ্য ছিল? অতিরিক্ত কর-ভার অত্যাচারমূলক শাসন। এমন অবস্থার ভিতর আরবী ভাষা ভাষীদের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে যদি কোন সৃজনশীল অবদান সৃষ্টি না হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চার্যের কিছুই নাই।
আরব-প্রাচ্য বিজেতার পুত্র মহান সুলায়মান (১৫২০–১৫৬৬)-এর আমলে তুর্ক সাম্রাজ্যের মহিমার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে এবং তার অব্যবহিত পরেই এর পতন শুরু হয়। পতনের যুগ দীর্ঘ ও জটিল ছিল। ১৬৮৩ সালে ভিয়েনা দখল করার নিষ্ফল প্রয়াসের পর তুর্ক-শক্তিতে আক্রমণের পালা, খতম হয়ে আত্মরক্ষার পালা শুরু হয়। শান্তির বদলে প্রধানতঃ যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য সাম্রাজ্যের সংগঠন, সাম্রাজ্যের বিপুল বিস্তৃতি, প্রজাপুঞ্জের মধ্যে হাজারো রকমারি, ধর্মীয় সংস্থাকে স্বায়ত্তশাসনের প্রচুর সুবিধা দান, মুসলিম তুর্ক আর মুসলিম আরবের মধ্যে বিভেদ, চূড়ান্ত ক্ষমতা সুলতান-খলীফার হাতে কেন্দ্রীভূতকরণ এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা–সাম্রাজ্যের সংস্থাপনায় এগুলি ছিল অন্তর্নিহিত দুবর্লতা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাশীয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মত বিভিন্ন শক্তি তুর্ক সাম্রাজ্যের নানা অংশের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি হানতে এবং তুরস্ক সম্বন্ধে বিশেষ নীতি অবলম্বন করতে শুরু করে। এর ফলে সাম্রাজ্যের পতনের স্রোত দ্রুততর হয়ে পড়ে। আরব-জগত এককালে পারস্য হতে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; ক্রমে সে বিশাল সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আসে। পারস্য ভাষা ও জাতীয়তা এর আগেই তার নিজস্ব আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার ঘোষণা করে। তুর্করা কন্সটানটিনোপল অধিকার (১৪৫৩) করার আগেই স্পেন কার্যতঃ স্বাধীন হয়ে যায়। উত্তর আফ্রিকা, মিসর, খাস আরব এবং আরব-হেলাল–আটলান্টিক হতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত এক অখণ্ড অঞ্চল। তাদের আরবী ভাষা ও ইসলামী বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে যেমন আজো তারা করছে। মরক্কো ছাড়া এসব দেশ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের আগ পর্যন্ত তুর্ক সাম্রাজ্যের অঙ্গ ছিল। একমাত্র লেবাননই বরাবর তার বাসিন্দাদের মধ্যে খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষা করে এসেছে।