যে গর্বিত বিজয়-দৃপ্ত শাসকেরা সিরিয়া হতে ফিরিঙ্গী আধিপত্যের নাম নিশানা মুছে ফেলেন এবং সাফল্যের সঙ্গে মঙ্গোল প্লাবনের সম্মুখে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ান, তাঁদেরই অধীনে মিসরের ইতিহাস শুরু হয়। যুগের শেষ ভাগে সামরিক চক্রের শাসন, প্রবল সম্প্রদায়সূহের মধ্যে কলহ, গুরু কর-ভার, ধন-প্রাণের নিরাপত্তার অভাব, ঘন ঘন প্লেগ, দুর্ভিক্ষ ও বিদ্রোহ–সমস্ত মিলে মিসর ও সিরিয়ার সর্বনাশ সাধনের বেশি কিছু বাকী ছিল না। নীলনদের উপত্যকায় কুসংস্কার ও ভোজবাজি বিশেষ রকমে প্রবল ছিল। সঙ্গে সঙ্গে গোঁড়া ধর্ম-মতও জয়লাভ করে। এই অবস্থায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন উচ্চ-শ্রেণীর সাধনাই সম্ভবপর ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, অষ্টম শতাব্দী হতে আরব জগতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে শীর্ষস্থান অধিকার করে আসছিল, এয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে তা হারিয়ে ফেলে। সর্বত্রই এ দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অনেক যুগব্যাপী কঠোর সাধনা এবং প্রভুত্ব সম্পদ জাত নৈতিক অধঃপতন মনে ক্লান্তির সঞ্চার করেছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগের পর আরবরা বিজ্ঞানের মাত্র দুটি শাখায় তাদের পূর্ব নেতৃত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয় : গ্রহ-বিজ্ঞান, গণিত (ট্রিগনোমেট্রী বা ত্রিকোণমিতি সহ) এবং চিকিৎসাশাস্ত্র বিশেষ করে চক্ষু-চিকিৎসা বিজ্ঞান। চিকিৎসা জগতে এ যুগে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ইবনুল নাফিস। ইনি দামেস্কে অধ্যয়ন, করেন এবং কায়রোর একটি হাসপাতালে দীর্ঘকাল প্রধান চিকিৎসকের কাজ করে ১২৮৯ সালে দামেস্কেই ইন্তিকাল করেন। দেহে রক্ত চলাচল পদ্ধতি আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় পর্তুগীজ পণ্ডিত সার্ভেটাসকে; কিন্তু তাঁর তিনশ’ বছর আগে ইবনুল নাফিস এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। আমরা এখন যাকে যৌন-সাহিত্য বলি, এ যুগে এই শ্রেণীর প্রচুর পুস্তক লিখিত হয়। আরবী সাহিত্য বরাবরই প্রধানতঃ পুরুষের সাহিত্য; এ সাহিত্যে এমন অজস্র উপাখ্যান, ব্যঙ্গ এবং মন্তব্য আছে, যা আজকে আমাদের কানে অশ্লীল শোনায়।
মামলুকরা প্রায়শঃ খুন-খারাবীতে লিপ্ত থাকত; অথচ সত্যি এ এক অপূর্ব বিস্ময়, তাদের আমলে যে উচ্চাঙ্গের চারুকলা ও স্থাপত্য শিল্প প্রভূত পরিমাণে বিকাশ লাভ করে, টলেমীয় ও ফেরাউনীয় যুগের পর মিসরের ইতিহাসে তার আর তুলনা নাই। এয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোল আক্রমণে বিতাড়িত হয়ে মসুল, বাগদাদ ও দামেস্ক হতে বহু মুসলমান শিল্পী ও কারিগর মিসরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদের সংস্পর্শে মামলুক স্থাপত্য রীতি সিরীয়-ইরাক আদর্শ নবভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ক্রুসেড শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার উত্তরে পাথর নির্মিত ইমারতের প্রাধান্য লাভের সুযোগ ঘটে এবং গম্বুজ তৈরীর কাজে ইটের বদলে পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। হাল্কা গম্বুজ অপূর্ব সাজে সজ্জিত হতে থাকে। সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন ও বিচিত্র বর্ণে পাথর সাজিয়ে দালান-কোঠার সৌন্দর্য বর্ধন এ যুগের এক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। স্থাপত্য শিল্পে জ্যামিতিক রেখা ও কুফী হরফের আলঙ্কারিক প্রয়োগ এ সময় বিশেষ বিকাশ লাভ করে। (মুসলমানদের সকল যুগেই স্পেন ও পারস্যের তুলনায় মিসর ও. সিরিয়ায় জীব-জন্তুর চিত্র কম ব্যবহৃত হয়েছে।) সুখের বিষয়, মামলুক স্থাপত্য রীতির প্রকৃষ্টতম নমুনা আজো টিকে আছে এবং পণ্ডিত ও ভ্রমণকারী উভয়ের জন্যই সে নমুনা এক পরম আকর্ষণের বস্তু।
চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে মামলুকদের কাহিনী সিরীয়-মিসরীয় ইতিহাসের শোচনীয়তম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। সুলতানদের কয়েকজন ছিলেন বিশ্বাসঘাতক ও রক্তপিপাসু; কয়েকজন ছিলেন অকর্মন্য–অধঃপতিত, আর বেশির ভাগই ছিলেন অমার্জিত। ১৪১২ হতে ১৪২১ সাল পর্যন্ত সুলতান ছিল মাতাল। তাকে এক সার্কেণীয়ার ব্যবসায়ীর নিকট হতে খরিদ করা হয়েছিল। ইনি কতকগুলি চরম দুর্নীতির কাজ করেন। অন্য এক সুলতান আরবী ভাষা জানতেন না। তিনি তার এক কঠিন ব্যারাম ভাল না করতে পারার জন্য তাঁর দুই জন চিকিৎসকের শিরচ্ছেদ করেন। ১৯৫৩ সালে যিনি রাজত্ব করেন, তিনি লিখতেও জানতেন না–পড়তেও জানতেন না। সরকারী দলীল-পত্রে তার সেক্রেটারী তার নাম লিখে দিত; তিনি তার উপর হাত ঘুরাতেন। তাঁর চরিত্রগত জঘন্য দোষের কথা বলাবলি হত। আব্বাসীয়দের কুখ্যাত গিমান প্রথা মামলুকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। এক খলিফা কেবল নিরক্ষর ছিলেন না, পাগলও ছিলেন। আর এক খলীফা (যাকে পঞ্চাশ দিনার দামে খরিদ করা হয়েছিল) এক আলকিমিয়াবিদ বাজে ধাতুকে সোনা করে দিতে পারে নাই বলে তার চোখ তুলে এবং জিভ কেটে ফেলেন।
সুলতানদের স্বার্থ-প্রণোদিত নীতির ফলে দেশের আর্থিত অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। যেমন এক সুলতান পাক-ভারত হতে মসলা আমদানী বন্ধ করে দেন; তারপর বাজারের সমস্ত মসলা নিজে সস্তা দরে কিনে তাঁর প্রজাদের মধ্যেই চড়া দরে বিক্রি করে প্রচুর লাভবান হন। তিনি চিনির একচেটিয়া ব্যবসায় শুরু কনে এবং অতিরিক্ত লাভের আশায় কিছুকাল আখের আবাদ পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। তার আমলে মিসর ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে এক ভয়াবহ প্লেগ দেখা দেয়। এই ব্যারামের ঔষধের জন্য চিনির প্রচুর চাহিদা হয়। কালো মৃত্যুর মত সর্বগ্রাসী না হলেও এ প্লেগে তিন মাসের মধ্যেই নাকি এক রাজধানীতেই তিন লক্ষ লোক মারা যায়। মানুষের পাপের জন্য এ প্লেগের আবির্ভাব ঘটেছে এই মনে করে তিনি মেয়েদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন এবং খৃস্টান ও ইহুদীদের উপর নতুন কর বসিয়ে কাফফারা আদায়ের চেষ্টা করেন।