উর্বর হেলালে সাম্রাজ্যের উত্থান হয়েছে-পতন হয়েছে; কিন্তু উষর মরুভূমিতে বেদুঈন বরাবর একই রয়ে গেছে। বেদুঈন, উট আর খেজুর গাছ মরুভূমিতে এদেরই প্রকৃত প্রভুত্ব। বালুকার সঙ্গে একত্র হয়ে এরা চারজনই এ মঞ্চের অভিনেতা। যেখানে আর কিছুই টিকতে পারে না, সেখানে দৃঢ়তা ও সহনশক্তির জোরে বেদুঈন বেঁচে থাকে। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র তার চিত্তে এমন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে আছে যে, তার মধ্যে কখনো সামাজিক সচেতনতা বিকাশ লাভ করে নাই। নিজের কওমের বাইরে সে পর হিতৈষণার কথা ভাবতে পারে না। নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা-রক্ষা ও কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য–এ সব তার আদর্শের অন্তর্গত নয়।
সেমিটিক ধর্মের অঙ্কুর প্রথম পাতা মেলে মধ্যানে-বালুময় ভূমিতে নয়। পাথর ও ফোয়ারাকে কেন্দ্র করে এ ধর্ম গড়ে উঠতে থাকে। এর থেকেই এসেছে ইসলামে ‘হাজরুল আসোয়াদ’ ও জজ এবং ওলটেষ্টামেন্টে বেথেল।
বেদুঈনের মরু-গৃহের বৈচিত্র্যহীনতা,ও অনুর্বরতা তার দৈহিক ও মানসিক প্রকৃতির উপর যথাযথ প্রতিফলিত হয়েছে। সে কতকগুলি হাড়ডি ও শিরা উপশিরার বোঝ। খেজুর ও দুধ তার খানার প্রধান দফা। খেজুর আর উটের গোশতই তার অতরল খাদ্য। খেজুর গাঁজিয়ে সে তার প্রিয় শরবত তৈরি করে। খেজুরের বিচি ভেঙ্গে সে রোজ তার উটকে খাওয়ায়। পানি আর খেজুর মরুভূমির এই দুটি মূল্যবান সম্পদের মালিক হওয়া বেদুঈনের দিনের ধ্যান, রাতের স্বপ্ন।
বেদুঈনের খাদ্যের মত তার কাপড়-চোপড়ও নিতান্ত অল্প। কটিবন্ধযুক্ত একটি লম্বা কামিজ এবং তার উপর একটি দোলায়মান দীর্ঘ জামা। মাথায় দড়িতে বাঁধা একটি চাদর। পাজামা তারা পরে না; পাদুকা দুষ্প্রাপ্য।
আরবের জীব-জানোয়ারের মধ্যে দুটি প্রধান–উট আর ঘোড়া। উট বাদ দিলে মরুভূমিতে বাস করা কল্পনার অতীত। উট বেদুঈনের খাদ্য, তার বাহন, তার মুদ্রা। কনের মোহর, রজের দাম, জুয়ার লাভ, শেখের ঐশ্বর্য সবেরই পরিমাণ উটের সংখ্যা দিয়ে ঠিক করা হয়। উট বেদুঈনের নিত্য সঙ্গী, পোষক পিতা, দ্বিতীয় সত্তা। সে পানির বদলে উটের দুধ খায় পানি রেখে দেয় সে উট, ভেড়া, বকরীর জন্য। সে উটের গোশত্ দিয়ে ভোজের আয়োজন করে, সে উটের চামড়া গায় দেয়–সে উটের পশম দিয়ে তাঁবু তৈরি করে। সে উটের বিষ্ঠা জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে, তার পেশাব দিয়ে চুলের টনিক ও দাওয়াই তৈরি করে। মাথা পরিষ্কারের জন্য ব্যবহার করলে এতে চুলে এক রকম খোশ পয়দা হয় এবং মুখমণ্ডলের উপর তেলের মত লেগে থাকে, যার ফলে মশা মাছি কামড়ায় না। বেদুঈনের কাছে উট কেবল জাহাজ নয়–উট আল্লার খাস নেয়ামত।
আজকের বেদুঈনরাও গর্ভের সঙ্গে নিজেদের পরিচয় দেয়–’আমরা উটের দেশের মানুষ।’ মুসিল ওয়ালাহ্ বেদুঈনদের সম্পর্কে তার লিখিত গ্রন্থে বলেন : সে কওমে এমন একটি লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, সে কোন না কোন সময় উটের পেটের পানি না খেয়েছে। জরুরী অবস্থায় হয় কোন বুড়ো উটকে জবে করা হয়, না হয় ওকে দিয়ে পানি বমি করার জন্য ওর গলার ভিতর একটা লম্বা কাঠি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। উট দুই-একদিন আগে পানি খেয়ে থাকলে তা মোটামুটি পানের উপযোগী থাকে।
পৃথিবীত আরবই উট পালনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। কাজে কাজেই উট-শিল্প এখনে আয়ের একটি বড় উৎস। আরবের অর্থনৈতিক জীবনে উটের স্থান যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা এ থেকেই বোজা যায় যে, উটের বিভিন্ন জাত, বিভিন্ন রং, বিভিন্ন অবস্থা এবং বিভিন্ন বয়স সম্বন্ধে নাকি আরবী ভাষায় এক হাজার শব্দ আছে। এক তলোয়ার ছাড়া আর কোন কিছুর জন্য ও ভাষায় এত প্রতিশব্দ নাই।
অন্যপক্ষে, ঘোড়া বিলাসের সামগ্রী। ঘোড়ার খাদ্য জোটানো ও যত্ন নেওয়া মরুবাসীর পক্ষে এক সমস্যা। ঘোড়া থাকলেই বুঝতে হবে যে, তার মালিক ধনবান ব্যক্তি। মুসলিম-সাহিত্যে আরবের ঘোড়া অপরূপ খ্যাতি লাভ কলেও প্রাচীন আরবে ঘোড়ার আমদানী হয়েছিল অনেক পরে। খৃস্ট-জন্মের পূর্বে ঘোড়া আরবে আসে। কিন্তু এবার এখানে এসে যাওয়ার পর সে তার রক্তকে সম্পূর্ণ অবিমিশ্র রাখার পুরোপুরি সুযোগ পেয়ে গেল। দৈহিক সৌন্দর্য, সহনশীলতা, বুদ্ধি ও মনিবের প্রতি অগাধ ভালবাসার জন্য আরবের তাজী বিশ্ববিখ্যাত। এইরূপ সংজাত তাজী হতেই পাশ্চাত্য জাতিসমূহ উচ্চবংশীয় ঘোড়া পালনের আইডিয়া ও আদর্শ গ্রহণ করেছে। খৃস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরবেরা স্পেনের মারফত ইউরোপে ঘোড়া সরবরাহ করে। বার্বারী ও আন্দালুসীয়ান ঘোড়ার মধ্যে সেই ঘোড়ারই নিদর্শন স্থায়ী হয়ে আছে। ক্রুসেডের আমলে বিলাতী ঘোড়া আরব ঘোড়ার সংশ্রব হতে নতুন রক্ত সঞ্চয় করে।
বেদুঈনের কাছে ঘোড়ার প্রধান মূল্য এই যে, অতর্কিত আক্রমণের সময় ঘোড়ার দ্রুত-গতি তারপক্ষে বিশেষ সহায়ক। খেলা-ধুলা, দৌড় এবং শিকারেও ঘোড়া ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আজকের কোন আরব তাবুতে পানির অভাব হলে শিশুরা পিয়াসে আর্তনাদ করতে পারে, কিন্তু তাবুর কর্তা সে আর্তনাদে বিচলিত হয়ে পানির শেষ ফোঁটাটি পর্যন্ত ঢেলে নিয়ে তার ঘোড়ার সামনে ধরবে।
অতর্কিত আক্রমণকে বেদুঈন ভাষায় গোজওয়া বলে। গোওয়ারে এক হিসেবে লুণ্ঠনাত্মক আক্রমণ বলা যেতে পারে। কিন্তু মরুভূমির আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা গোজওয়াকে এক জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। বেদুঈনের এই যে পশু পালন-প্রধান সামাজিক জীবন এর থেকেই গোওয়ার উদ্ভব। মরু-জীবনে যুদ্ধের জোশ মানুষের মনে নিত্য-জাগ্রত। কাজেই গোজওয়া সে জীবনে একটি বীরোচিত পেশা। খৃস্টান কওমেরাও এ পেশা অবলম্বন করত। সেকালের একজন কবি এমন জীবনের নীতি সম্বন্ধে দুই লাইনে সুন্দর বলেছেন :দুশমনের উপর গোজওয়া করা আমাদের পেশা। দুশমন না পেলে আমরা প্রতিবেশীর উপর হামলা চালাই; প্রতিবেশীও না মিলে অগত্যা আমরা ভাইকে আক্রমণ করি।’