সিরিয়ার বাজার গন্ধদ্রব্য, মসলা, মিঠাই এবং আরব ও ভারতের অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্যে ভরপুর থাকত। প্রাচ্য দেশে অবস্থানকালে ফিরিঙ্গীরা এইসব দ্রব্যের অনুরক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে তাদের এই রুচি ইটালী ও ভূমধ্যসাগরীয় শহরগুলির বাণিজের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আরবের ধূপ-ধুনা, দামেস্কের গোলাব, গন্ধ-দ্রব্য বহু রকমের সুগন্ধ তেল এবং পারস্যের আতর সকলের প্রিয় হয়ে ওঠে। ফিটকিরির সঙ্গেও এই সময় পাশ্চাত্য-জগত পরিচিত হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে লবণ ও গোল মরিচ জাতীয় সুগন্ধি মসলা প্রবর্তিত হয়। এই সময় হতে পাশ্চাত্য জগতে মসলাওয়ালা রান্না ছাড়া ভোজনের কোন আয়োজনই পূর্ণ বিবেচিত হত না।
ক্রুসেডাররা তাদের রান্নায় আদা (জিঞ্জার–আরবী শব্দ) খেতে শিখে মিসরে। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল চিনি (সুগার–আরবী শাককর) খাওয়া শিক্ষা। এ যাবতকাল পর্যন্ত ইউরোপীয়রা তাদের খাদ্যবস্তু মিষ্টি করার জন্য মধু ব্যবহার করত। লেবানন ও সিরিয়ার উপকূলবর্তী স্থানে এখনো বালক বালিকাদের আখ চিবাতে দেখা যায়। এইখানেই ক্রুসেডাররা আখের সঙ্গে পরিচিত হয়। তারপর হতেই আখ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় কি গুরুত্ত্বপূর্ণ স্থানই না অধিকার করে আসছে। পাশ্চাত্য জগতে প্রবর্তিত বিলাস-দ্রব্যের মধ্যে চিনিই প্রথম এবং তারা আর কোন কিছু খেয়েই এত মজা পায় না। চিনির সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশে যায় শরবত, গোলাব পানি, নানারকম ফুল, সমস্ত রকম মিছরী (ক্যাভী–আরবী শব্দ হতে উদ্ভুত) এবং মিঠাই। মসলীন, দেমাস্ক, আতলাস ও সাটিন প্রভৃতি সূক্ষ্ম বস্ত্র যে আরব-প্রাচ্য হতে আমদানী হয়, এসবের নামেই তার পরিচয় মিলে।
প্রাচ্যের কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের জন্য ইউরোপীয় বাজারের সৃষ্টি এবং তীর্থযাত্রী ও ক্রুসেডারদের চলাচলের প্রয়োজনের তাগিদে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এত প্রসার লাভ করে যে, রোমক শাসনের পর অমন আর দেখা যায় নাই। সামুদ্রিক বন্দর হিসেবে এবং ঐশ্বর্যের দিক দিয়ে মার্সাই ইটালীর সিটি রিপাবলিকগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করে। নতুন পরিস্থিতির আর্থিক তাগিদে মুদ্রার ব্যাপকভাবে উৎপাদন ও দ্রুততর প্রবহনের প্রয়োজন হয়। এ কারণেই এরকম ক্রেডিট নোটের উদ্ভাবন হয়। জেনোয়া ও পিসায় ব্যাঙ্ক স্থাপিত হয় এবং লেভান্টে খোলা হয় তার শাখা। টেম্পলাররা হুণ্ডীর কারবার শুরু করে।
ক্রুসেড উপলক্ষে দ্রুত ও ব্যাপকতর জাহাজ-চলাচলের প্রয়োজন হতে কম্পাসের আবিষ্কার ঘটে। চুম্বক কাটার দিক নির্ণয়ক গুণ সম্বন্ধে বোধহয় প্রথম অবহিত হয় চীন দেশ। কিন্তু মুসলমানরা বহু আগে পারস্য উপসাগর ও দূর প্রাচ্যের সমুদ্রসমূহের মধ্যে বাণিজ্য করত এবং সেই সময়ই তারা জাহাজ চলাচলের ব্যাপারে চুম্বক কাটার যথাযথ প্রয়োেগ শুরু করে। তারপর তারা তাদের এই আবিষ্কার ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়।
এই যুগে সামগ্রিকভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যে সংকোচন শুরু হয় আর মুসলিম মানসে স্থবিরতা দেখা দেয়। আর ঠিক এসময়ই আকস্মিকভাবে সম্প্রসারিত জগতের প্রতি ইউরোপীয়দের দৃষ্টি প্রসারিত হতে শুরু করে। মুসলমানদের এই সাম্রাজ্যের অবসানের আগে সিরীয়-মিসরীয় মামলুক বংশ তার পুনরুজ্জীবনের জন্য শেষ চেষ্টা করে।
১৮. শেষ শাসক বংশ
মধ্যযুগীয় আরব-জগতের সর্বশেষ বংশ মামলুকরা সবদিক থেকে অসাধারণ ছিল। মুসলিম-ইতিহাসে ছাড়া এমন একটি জাতির উত্থান ও প্রসার কল্পনার অতীত ছিল বলেই মনে হয়। মামলুক শব্দের মানে ‘অধিকৃত।’ মামলুকরা দাস বংশীয় লোক ছিল? বহু গোষ্ঠীর, বহু জাতির বহু গোলাম পরদেশে এসে এক সম্মিলিত সামরিক শাসক-শক্তি গড়ে তোলে। বহু শতাব্দী হতে আরব সমাজ জীবনে যে অনাচার অব্যাহত গতিতে চলে আসছিল, এদের সৃষ্টি তারই অনিবার্য ফল । কিন্তু এরা কীর্তিমান লোক ছিল এবং বিলীয়মান আরব সাম্রাজ্যের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে স্থান পাওয়ার এরা যথার্থ অধিকারী।
মামলুকরা তাদের সিরীয়-মিসরীয় রাজ্য হতে বাকী ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করে। তারা হালাকু ও তৈমুরের দুর্দান্ত লুণ্ঠনপ্রবণ অনুচরদের অগ্রগমন চিরদিনের তরে রুদ্ধ করে দেয়; নইলে মঙ্গোলরা সমগ্র মিসর ও পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রবাহ-পথ সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দিতে পারত। সিরিয়া ও ইরাকের উপর যে ধ্বংসের প্লাবন নেমে আসে, এদেরই জন্য মিসর সে প্লাবনের হাত হতে বেঁচে যায় এবং আরবের বাইরে সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক স্থায়িত্বের ব্যাপারে যে নিরবচ্ছিন্নতা আর কোন রাজ্য ভোগ করে নাই, মিসর তা-ই ভোগ করে। প্রায় পৌণে তিন শতাব্দী (১২৫০–১৫১৭) পর্যন্ত মামলুকরা সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক অশান্ত একটা এলাকার উপর আধিপত্য করে এবং সব সময়েই নিজেদের গোষ্ঠিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলে। সত্য বটে, তারা মোটামুটি রক্তপিপাসু ছিল, তথাপি চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পের প্রসারে তাদের অবদান যেকোন সভ্য বংশের পক্ষে গৌরবের কথা হতে পারত। তাদেরই জন্য আজো মুসলিম জগতের মধ্যে সৌন্দর্য নিকেতন হিসেবে কায়রো একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। অবশেষে ১৫১৭ সালে ওসমানীয় বংশের সলীম তাদের উৎখাত করলে আরব খিলাফতের ধ্বংস্তূপ হতে উখিত বংশাবলীর শেষ বংশের দীপ নিভে গেল–আর পথ খোলাসা হয়ে গেল এক অনারব খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য। এরা ওসমানীয় তুর্ক।