ক্রুসেড উপলক্ষে বহু রোমাঞ্চকর ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় এর ঐতিহাসিক মূল্য অতিরঞ্জিত হয়েছে। প্রাচ্যের তুলনায় পাশ্চাত্য জগত এর দ্বারা অনেক বেশী উপকৃত হয়; সাহিত্য ও বিজ্ঞানের চেয়ে চারু-কলা, শিল্প ও বাণিজ্য-সভ্যতার বিস্তার ঘটে। এরই সঙ্গে ক্রুসেডাররা সিরিয়ায় রেখে আসে নিরবচ্ছিন্ন ধ্বংসের লীলা এবং সমগ্র নিকট প্রাচ্যময় ছড়িয়ে আসে খৃষ্টান মুসলমানের মধ্যে এক বিষময় বিদ্বেষ। আজো সে বিদ্বেষের চিহ্ন মুছে যায় নাই।
ক্রুসেডের যুগের আগেই প্রাচ্যের মুসলিম তমদ্দুনে ভাটা শুরু হয়। দর্শন, চিকিৎসা, সঙ্গীত ও অন্যান্য অনুশীলনের ক্ষেত্রে জ্ঞানের মশাল তখন নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সিরিয়া ইসলাম ও পাশ্চাত্য খৃস্টান ধর্মের সাক্ষাৎকেন্দ্র ছিল। কিন্তু অতঃপর প্রধানতঃ প্রাচ্য ইসলামের সাংস্কৃতিক অবনতির জন্যই সিরিয়া আরব প্রভাব বিস্তারের কাজে স্পেন, সিসিলী, উত্তর সিসিলী, উত্তর আফ্রিকা, এমনকি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেরও পেছনে পড়ে যায়। একথা সত্য যে, ক্রুসেডারদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ মারফত সিরিয়ায় ইসলাম পাশ্চাত্য খৃস্টান ধর্মের উপর প্রভাব বিস্তার করে; আর সেই প্রভাব সমগ্র পাশ্চাত্যের উপর আংশিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাণিজ্য-পথ ধরেও এ প্রভাব পাশ্চাত্যের বুকে অনুপ্রবিষ্ট হয়। তবে সিরিয়া ক্রুসেডারদের উপর যে আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করে, তা নগণ্য। অন্যদিকে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ক্রুসেডারদের সাংস্কৃতিক মান আক্রান্ত মুসলমানদের সাংস্কৃতিক মানের চেয়ে নিম্নতর ছিল। ক্রুসেডারদের মধ্যে বহু দেশের বহু রকমের মানুষ এসে এলোমেলোভাবে জমা হয়। তারা দেশের অভ্যন্তরে কেল্লায় কেল্লায় বাস করে ও প্রধানতঃ স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের সংস্রবে আসে; বুদ্ধিজীবীদের সাহচর্যে আসার সুযোগ তারা পায় না। এর উপর ছিল জাতি ও ধর্মগত কুসংস্কার; তার ফলে আক্রমণকারী ও আক্রান্ত জাতিসমূহের মধ্যে ভাবের যথেষ্ট আদান-প্রদান হতে পারে নাই। ফিরিঙ্গীদের পক্ষে সাহিত্য ও বিজ্ঞানে স্থানীয় লোকদের কিছুই শিক্ষা দিবার ছিল না। সমসাময়িক আরব ঐতিহাসিকরা ফিরিঙ্গীদের চিকিৎসা-জ্ঞান সম্বন্ধে হাস্যকর উপাখ্যান লিপিবদ্ধ করে; তারা বিদ্রুপের ভাষায় এ কথাও উল্লেখ করে যে, ‘ফিরিঙ্গীদের আইন-শাস্ত্র অদ্ভুত, তারা দ্বন্দ্বযুদ্ধ ও পানির সাহায্যে অপরাধ নির্ণয় করে।’
দ্বাদশ শতাব্দী হতে সমগ্র ইউরোপে আমরা মুসাফিরখানা ও হাসপাতাল বিশেষ করে কুষ্ঠাশ্ৰম স্থাপিত হচ্ছে দেখতে পাই। স্পষ্টতঃই নিয়মিত হাসপাতাল স্থাপন মুসলিম-প্রাচ্যের প্রভাবেরই ফল। মুসলমানদের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই ইউরোপে সরকারী গোসলখানা প্রবর্তিত হয়। এক সময়ে রোমকরা এ প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা এবং খৃস্টানরা বিরোধিতা করত।
সাহিত্য ক্রুসেড ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। পবিত্র মধ্যপাত্র বিষয়ক উপকথায় নিঃসন্দেহ রকমে সিরিয় উপাদান বিদ্যমান আছে। ক্রুসেডারগণ নিশ্চয়ই বিদপাই’ ও আরব উপন্যাসের কাহিনী শুনে তা তাদের দেশে নিয়ে যায়। চসারের ‘স্কোয়ারের কাহিনী’ আসলে আরব্য উপন্যাসের কাহিনী বিশেষ। বোকাশিয়ে মুখে মুখে প্রাচ্য কাহিনী শুনে তা তাঁর ‘ডেকামিরন” নামক গ্রন্থের শামিল করেন। আরবী ও অন্যান্য ইসলামী ভাষা অনুশীলনে উৎসাহ বৃদ্ধিও সেডারদেরই প্রভাবের ফল।
যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যাপারে ক্রুসেডের প্রভাব আরো সুস্পষ্ট। যুদ্ধে ঘোড়া, গায় ভারী জেরা ও বর্মের নীচে তুলার গদী ব্যবহার–এসব ক্রুসেডেরই প্রত্যক্ষ অবদান। সিরিয়ায় ফিরিঙ্গীরা যুদ্ধের বাজনায় মৃদঙ্গ ও দামামা ব্যবহার শুরু করে; আগে তারা কেবল শিঙ্গা ও তুর্য ব্যবহার করত। যুদ্ধের খবর আদান প্রদানের কাজে কবুতর ব্যবহার ক্রুসেডাররা আরবদের নিকট শিক্ষা করে। আরবদের নিকট হতেই তারা বিজয় উৎসবে আলোকসজ্জা ও টুনামেন্ট নামক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানের শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে, শিভালরী প্রতিষ্ঠানের কোন কোন বৈশিষ্ট্য সিরিয়াতেই গড়ে ওঠে। মুসলিম-যোদ্ধাদের সংস্পর্শের ফলেই ইউরোপে সমরাস্ত্র ও অভিনব সামরিক পরিচ্ছেদের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়।
ক্রুসেডাররা অবরোধ সংক্রান্ত কায়দা-কানুনের অনেক উন্নতি বিধান করে । নানা রকম বিস্ফোরক পদার্থের ব্যবহার তাদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়। বারুদ চীন দেশে আবিষ্কৃত হয় বলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। তবে সেখানে ইহা কেবল আগুন জ্বালানোর কাজেই ব্যবহৃত হতে থাকে। মঙ্গোলরা বারুদ চীন হতে নিয়ে ইউরোপে প্রবর্তন করে। বারুদের সাধারণ ব্যবহার হতে চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই ইউরোপে আগ্নেয়াস্ত্রের উদ্ভাবন হয়। ইউরোপ ভূখণ্ডে মার্ক নামক একজন গ্রীকের ১৩০০ সালের কাছাকাছি লিখিত একখানি গ্রন্থের পরিশিষ্টে সর্বপ্রথম বারুদ প্রস্তুত-প্রণালীর বর্ণনা পাওয়া যায়; বেকনের বারুদ তৈরীর বর্ণনা প্রক্ষিপ্ত ।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতের চেয়ে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য জগতে ক্রুসেড অধিকতর ফলপ্রসূ হয়। ক্রুসেডের মারফতই পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে নতুন নতুন শস্য ও ফল গাছের আবাদ প্রসার লাভ করে। এ গুলির মধ্যে তিল, জোয়ার, ধান, লেবু, তরমুজ, খুবানী, গন্ধ-পিয়াজ প্রভৃতি অন্যতম। লেমন (লেবু) শব্দের মূল আরবী লেমুন’; শেলট অথবা স্কেলিয়ন (গন্ধ-পিয়াজ) শব্দের মূল মানে ছিল এস্কালনের পিয়াজ। এ শব্দের উদ্ভব স্থান ফিলিস্তিন। বহুকাল পর্যন্ত খুবানীকে দামেস্কের আলুবোখারা বলা হত।