দুটি শর্তে কেল্লা আত্মসমর্পণ করে? পয়লা শর্ত–২ লক্ষ দিনারের বদলে কেল্লার সমস্ত সৈন্যকে ছেড়ে দেওয়া হবে; দ্বিতীয় শর্ত-পবিত্র জুস খৃস্টানদের ফেরত দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যেও মুক্তি-মূল্য আদায় না হওয়ায় রিচার্ডের আদেশে সাতাইশ শ’ বন্দীকে হত্যা করা হয়। সালাহউদ্দীন যখন জেরুজালেম জয় করেন, তখন সেখানকার বন্দীদের প্রতি তার যে ব্যবহার, তার সঙ্গে রিচার্ডের এ নিষ্ঠুর ব্যবহারের কি শোচনীয় পার্থক্য! তিনিও বন্দীদের কাছে মুক্তি মূল্য চেয়েছিলেন। কয়েক হাজার গরীব তাদের মুক্তি-মূল্য দিতে অসমর্থ হয়। সালাহ্উদ্দীনের ভাইয়ের সুপারিশে তিনি এদের এক হাজার জনকে ছেড়ে দেন। প্রধান পুরোহিতের অনুরোধে আরো একদলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর সুলতান ভাবেন–ভাই আর পুরোহিত তো তাদের কর্তব্য পালন করলেন, এখন আমাকেও তো কিছু করতে হয়। তখন তিনি নারী ও শিশু-সহ বহু বন্দীকে বিনা মূল্যে আযাদী দিয়ে দেন।
জেরুজালেমের নেতৃত্ব এখন থেকে এস্তুকারে কেন্দ্রীভূত হয় এবং দুই প্রতিদ্বন্দী যোদ্ধাদলের মধ্যে শান্তির জন্য অনবরত প্রস্তাব চলতে থাকে। রিচার্ডের মন রোমাঞ্চকর কল্পনায় পরিপূর্ণ ছিল। তিনি সালাহ্উদ্দীনের ভাইয়ের সঙ্গে তার বোনের বিয়ের প্রস্তাব করলেন–তারপর বিয়ের যৌতুক স্বরূপ নব দম্পতিকে জেরুজালেম উপহার দানের কথা ঘোষণা করলেন। এইভাবে তিনি খৃষ্টান ও মুসলমানদের এ যুদ্ধ পরিসমাপ্তির পথ প্রশস্ত করতে চাইলেন। ১১৯২ সালের ২৯ মে তিনি তার ভাইয়ের ছেলেকে পরিপূর্ণ উৎসবের মধ্যে নাইটের মর্যদায় ভূষিত করেন। অবশেষে ১১৯২ সালের ২ ডিসেম্বর এই শর্তে সন্ধি স্থাপিত হয় যে, উপকূলের শহরগুলি ল্যাটিনদের হাতে থাকবে, আর ভিতরের সমস্ত এলাকা থাকবে মুসলমানদের হাতে এবং পবিত্র শহরের তীর্থযাত্রিগণের উপর কোন রকম জুলুম করা হবে না। সালাহউদ্দীন বেশীদিন এ শান্তি ভোগ করতে পারেন নাই। ১১৯৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী দামেস্কে তার জ্বর হয় এবং এর বারো দিন পর পঞ্চান্ন বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। উমাইয়া মসজিদের পার্শ্বে এক অনাড়ম্বর সমাধি শয্যায় তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তিনি কেবল একজন যোদ্ধা ও সুন্নি আদর্শের পৃষ্ঠপোষক হিলেন না; তিনি আরো কিছু ছিলেন। তিনি বিদ্বানদের সাহায্য করেন, ধর্ম-শাস্ত্র অধ্যয়নে উৎসাহ দেন, অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন, মাদ্রাসা ও মসজিদ তৈরী করেন। তার স্থাপত্য কীর্তির মধ্যে কায়রোর কেল্লা আজো টিকে আছে। ১৯৮৩ সালে তিনি এই কেল্লা ও শহরের দেয়াল নির্মাণ শুরু করেন এবং এ কাজে তিনি ছোট ছোট পিরামিডের পাথর ব্যবহার করেন। তাঁর স্বধর্মীদের মধ্যে হারুণ ও বায়বার্স-এর উপরে তার স্থান। ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ডে তিনি চারণ ও ঔপন্যাসিকদের কল্পনা বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত করেন এবং এখনো তাকে আদর্শ নাইট হিসেবে গণ্য করা হয়।
এরপর একশ বছর পর্যন্ত মাঝে মাঝেই লড়াই চলতে থাকে; কিন্তু তার ফলে কোন পক্ষেরই কোন সুনির্দিষ্ট লাভ হয় নাই। ল্যাটিনরা মোটামুটি তাদের অধিকার রক্ষা করে চলে। ইতিমধ্য ফ্রান্সের নবম লুই ও তার বীর যোদ্ধারা ষষ্ঠ ক্রুসেড শুরু করেন। ইতিহাসে এ রাজা সাধু লুই নামে বিখ্যাত। ইনি ১২৪৯ সালে মিসরের অন্তর্গত দিমিয়াত শহর দখল করেন। এরপর তার সৈন্যরা এক জলাভূমির ভিতর দিয়ে কায়রো অভিমুখে মার্চ করতে শুরু করে। তখন নীলনদে পূর্ণ বর্ষা; জলাভূমিতেও বহু আঁকাবাঁকা খাল ছিল। এই অবস্থায় লুইয়ের সৈন্যদলে বিষম মড়ক দেখা দেয়। সৈন্যদের যাতায়াতের পথ একদম বন্ধ করে দেওয়া হয়; সমস্ত সৈন্যদল ধ্বংস হয়ে যায়; রাজা লুই তার অধিকাংশ আমীর রইসসহ বন্দী হন। একমাস কারা? রে থাকার পর উপযুক্ত মুক্তি-মূল্য ও দিমিয়াত ফেরত দেবার শর্তে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ১২৭০ সালে লুই তিউনিসে আর একটি ক্রুসেডীয় বাহিনী নিয়ে অভিযান করেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ক্রুসেডকারী সমস্ত নেতার মধ্যে তার চরিত্র মহত্তম ছিল।
এই সময় মিসরের মামলুক দাস-বংশে বায়বার্স নামে এক অসম সাহসী যোদ্ধার আবির্ভাব হয়। তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত শাসক বংশ ক্রুসেডারদের উপর চরম আঘাত হানেন। ১২৬৩ সালে বায়বার্স করক অধিকার করে নাজারেথের গীর্জা ভূমিসাৎ করেন। তাঁর দুর্বার আক্রমণের ফলে সিজারীয়া, জাফফা ও এনটিয়কের পতন ঘটে। এনটিয়কের কেল্লায় ১৬ হাজার সৈন্য ছিল; তাদের হত্যা করা হয় এবং ১ লক্ষ নর-নারী বালক-বৃদ্ধকে বন্দী করে বাজারে গোলাম রূপে বিক্রি করা হয়। লুণ্ঠনের জিনিস ভাগ করার সময় মুদ্রা পেয়ালায় ওজন করা হয়। এ ক্ষয়-ক্ষতির ফলে এনটিয়ক আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নাই।
বায়বার্সের উত্তরাধিকারীদের আমলে একার অবরুদ্ধ হয়; বিরানব্বইটি অবরোধ-স্তম্ভ হতে দুর্গ প্রকারের উপর প্রস্তর-বর্ষণ হতে থাকে এবং ১২৯১ সালে এর দেয়াল ভেঙ্গে ফেলা হয়। এর টেম্পলার রক্ষীরা নিহত হয়। মুসলিম বাহিনী সেই বছরই টায়ার, সিডন, বৈরুত এবং আন্তাতাস দখল করে। ক্রুসেডারগণ বিতাড়িত হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এইরূপে সিরিয়ার ইতিহাসের একটি রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের অবসান ঘটে।