খৃস্টানরা সিরিয়া এবং মিসরের অধিকাংশ স্থান জয় করে নেয়। মুসলিম জগতে ১১২৭ হতে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। আর তারই ফলে রঙ্গমঞ্চের কেন্দ্রস্থলে আবির্ভূত হন এক অসাধারণ বীর পুরুষ সালাহ্উদ্দীন আল-মালিক আল-নাসির আস সুলতান সালাহউদ্দীন ইউসুফ। সিরিয়ার এক কুর্দ পরিবারে এর জন্ম হয় ১৯৬৯ সালে। ইনি মিসরের উজীরের পদে কাজ করেন। তারপর ইনি মিসর হতে শীয়া মতবাদ উৎসাদনে এবং ফিরিঙ্গীদের বিরুদ্ধে জেহাদে নিজকে উৎসর্গ করেন।
ছয়দিন অবরোধের পর ১১৮৭ সালের ১ জুলাই সালাহ্উদ্দীন টাইবেরিয়াস দখল করেন। এরপর এল সন্নিহিত হিট্টিনের লড়াই। এ লড়াই শুরু হয় শুক্রবারে; সালাহ্উদ্দীনের লড়াই শুরু করার এই-ই ছিল একটি প্রিয় দিন। আর ফিরিঙ্গীদের জন্য এ ছিল এক বিষাদময় দিন। তারা সংখ্যায় প্রায় বিশ হাজার ছিল; পিপাসায় কাতর অবস্থায় তারা প্রায় সকলেই দুশমনের হাতে বন্দী হয়। সম্ভ্রান্ত বন্দীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অভিজাত ছিলেন জেরুজালেমের রাজা গাই-ডি লুসিগনান। বীর সুলতান ক্ষুণ্ণ রাজাকে পরম সমাদরে গ্রহণ করেন; কিন্তু তার সঙ্গী চ্যাটিলনের রেজিনান্ডের জন্য অন্য ব্যবস্থা করা হয়। সমস্ত ল্যাটিন নেতার মধ্যে রেজিনাল্ডই বোধহয় সর্বাপেক্ষা দুঃসাহসী এবং সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিপরায়ণ ছিলেন। তিনি সবচেয়ে ভাল আরবী বলতে পারতেন। তিনি কারাক (ল্যাটিনে) ‘ক্রাক’ শহরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে একাধিকবার নিকটবর্তী পথে নিরীহ কাফেলা লুণ্ঠন করেন। তিনি একটি নৌবাহিনী নিয়ে হজযাত্রীদের উপর আক্রমণ দ্বারা হেজাজের পবিত্র উপকূলে উৎপাত করেন। সালাহ্উদ্দীন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি নিজ হাতে এই সন্ধি ভঙ্গকারীকে হত্যা করবেন। এইবার তার প্রতিজ্ঞা পূরণের সুযোগ আসে। আরবের মেহমানদারীর সনাতন রীতি অনুযায়ী কোন লোককে কিছু খেতে দিলে আর তার উপর অস্ত্র ধারণ করা চলে না। সেই সুযোগ নেওয়ার মতলবে রেজিনাল্ড সালাহউদ্দীনের তাঁবু হতে এক গেলাস পানি চেয়ে খান। কিন্তু এ পানি সালাহ্উদ্দিন নিজে খেতে দেন নাই; কাজেই দুইয়ের মধ্যে মেজবান ও মেহবান সম্বন্ধ স্থাপিত হতে পারে নাই। রেজিনাল্ডকে তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য জান দিতে হল। টেম্পলার ও হস্পিটালার নামীয় যোদ্ধাদের সবাইকে প্রকাশ্য স্থানে হত্যা করা হয়।
হিট্টিনের বিজয়ে ফিরিঙ্গীদের কপাল ভাঙ্গে। এক সপ্তাহের অবরোধের পর জেরুজালেম ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর আত্মসমর্পণ করে। আকসা মসজিদে খৃস্টানদের ঘণ্টা-ধ্বনির স্থলে মুয়াজ্জিনের আজান ধ্বনি শুরু হয় এবং প্রস্তর গম্বুজের উপর যে সোনার ক্রুস ছিল, সালাহউদ্দীনের সৈন্যরা তা ছিঁড়ে নামিয়ে আনে।
ল্যাটিন রাজ্যের রাজধানী দখল হওয়ায় সিরিয়া-ফিলিস্তিনের বেশীর ভাগ ফিরিঙ্গী শহরই সালাহ্উদ্দীনের হাতে আসে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত কয়েকটি অভিযানে তিন বাকী দুর্গগুলি দখল করে নেন। দেশ হতে ফিরিঙ্গীদের সমূলে উচ্ছন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। কয়েকটি ছোট ছোট শহর ও কেল্লাসহ কেবল এনটিয়ক, ত্রিপলী এবং টায়ার তাদের হাতে থাকে।
জেরুজালেমের পতন ইউরোপকে জাগিয়ে তোলে। রাজায় রাজায় কলহ তারা ভুলে যায়। জার্মানীর সম্রাট ফ্রেডারিক বারবারোসা, ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড কোর-ডি-লায়ন এবং ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাস ক্রুস ধারণ করে তলোয়ার খোলেন। পশ্চিম ইউরোপে এরাই ছিলেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্যেশ্বর এবং এঁদেরই নিয়ে শুরু হয় তৃতীয় ক্রুসেড (১১৮৯ ১১৯২)। এঁদের সৈন্যসংখ্যা ছিল বিপুল। এ ক্রুসেডের ময়দানে একদিকে সালাহ্উদ্দীন, অন্যদিকে কোর-ডি-লায়ন (সিংহ-হৃদয়)-এই দুই দুর্দোণ্ডপ্রতাপ প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যে কত কাব্য কাহিনীই না রচিত হয়েছে।
ফ্রেডারিক সকলের আগে যাত্রা করেন ও স্থল পথে অগ্রসর হন; কিন্তু পথি মধ্যে সিসিলীর একটি নদী পার হওয়ার সময় ডুবে মারা যান। তাঁর অনুচরদের বেশীর ভাগই দেশে ফিরে যায়। যাওয়ার পথে রিচার্ড সাইপ্রাস অধিকার করেন। পরবর্তীকালে এই সাইপ্রাসই মূল-ভূমি হতে বিতাড়িত ক্রুসেডারদের শেষ আশ্রয় স্থল হয়ে দাঁড়ায়।
ইতিমধ্যে জেরুজালেমের ল্যাটিনরা সাব্যস্ত করে যে, তাদের হৃত রাজ্য উদ্ধার করতে একার চাবিকাঠির কাজ করতে পারে। সুতরাং, তাদের সমস্ত সৈন্য-বল একত্র করে তারা একারের পানে যাত্রা করে। ফ্রেডারিকের বাকী সৈন্য দল ও ফ্রান্সের রাজার কয়েক দল যোদ্ধা এসে এদের সঙ্গে যোগ দেয়। রাজা গুই সালাহ্উদ্দীনের হাতে বন্দী ছিলেন। তিনি আর কোনদিন সুলতানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না এই শর্তে সুলতান তাকে কিছুকাল আগে মুক্তি দেন। সেই গুই এসে একার আক্রমণের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আক্রান্ত নগর পুনরুদ্ধার করার জন্য পরদিনই সালাহ্উদ্দীন এসে হাজির হন ও দুশমনদের শিবিরের । অপর দিকে তাঁবু গাড়েন। জলে-স্থলে সংগ্রাম চলতে থাকে। রিচার্ডের আগমনে ক্রুসেডাররা উল্লসিত হয়ে ওঠে ও খুশীতে বাজী পোড়ায়। অবরোধকালে বহু চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটে এবং আরবী ও ল্যাটিন উভয় ভাষাতেই তার মনোরম বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়। সালাহ্উদ্দীন এবং রিচার্ডের মধ্যে উপহার আদান-প্রদানও চলে; তবে উভয়ের মধ্যে সাক্ষাৎ হয় নাই। শহরের দেয়াল হতে প্রত্যেক পাথর খুলে আনার জন্য রিচার্ড প্রচুর পুরস্কার ঘোষণা করেন। ফলে পুরুষ ও নারী অনেকেই অসাধারণ সাহসের পরিচয় দেয়। কেউ কেউ এই অবরোধকে মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান সামরিক অভিযান বলে মনে করেন। দীর্ঘ দুই বছর পর্যন্ত অবরোধ চলতে থাকে–১১৮৯ সালের ২৭ আগস্ট হতে ১১৯১ সালের ১২ জুলাই পর্যন্ত। ফিরিঙ্গীদের সুবিধা ছিল, তাদের নৌ-বাহিনী আর অবরোধের আধুনিক যন্ত্রপাতি মুসলমানদের সুবিধা ছিল, তাদের এক নেতৃত্ব। শেষ পর্যন্ত কেল্লার পতন হয়।