১০৯৫ সালের ২৬ নভেম্বর পোপ আরবান দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের ক্লারমন্ট নামক স্থানে যে বক্তৃতা দেন, জগতের ইতিহাসে অমন কার্যকরী বক্তৃতা বোধহয় আর কেউ কখনো দেন নাই। তিনি ধার্মিকদের সম্বোধন করে পবিত্র জেরুজালেমের পথে অগ্রসর হয়ে সে স্থানকে পাপিষ্ঠ জাতির হাত হতে উদ্ধার করে নিজেদের অধীনে আনতে আহ্বান জানান। এ যুদ্ধ ঈশ্বর চান–এই ধ্বনি দেশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ছোট বড় সবাইকে উন্মত্ত করে তোলে। পরবর্তী বছর বসন্তকালে দেড়লক্ষ লোক এ আবেদনে সাড়া দেয় এবং কন্সটানটিনোপলে একত্র হয়। এদের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিল ফিরিঙ্গী (ফ্রাঙ্ক) ও নর্মান। এদের সবাই নিজ নিজ পোশাকে ক্রুস চিহ্ন বহন করত; তাই এদের অভিযানের নাম হয় ক্রুসেড। এইরূপে প্রথম ক্রুসেড শুরু হয়।
যারা ক্রুস বহন করে যাত্রা করে, তাদের সবাই যে ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অগ্রসর হয়, এমন নয়। বোহেমন্ড-এর মত কতিপয় নেতা নিজেদের জন্য ছোট খাটো রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। পিসা, ভেনিস ও জেনোয়ার সওদাগরগণ ব্যবসায়ের সুযোগ খুঁজতে বের হয়; দুঃসাহসী ও ধর্মোম্মাদগণ নতুন কর্মক্ষেত্রের অনুসন্ধানে গৃহ ত্যাগ করে এবং পাপীরা এই পথে প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। ফ্রান্স, লোরেইন, ইটালী এবং সিসিলীর দারিদ্র-পীড়িত জনসাধারণ ক্রুসেডে যাওয়াকে ত্যাগ স্বীকার মনে না করে বরং লাভজনকই মনে করত।
ক্রুসেডকে সাত হতে নয় সংখ্যায় বিভক্ত করার যে সনাতন নীতি চলে আসছে, তা সন্তোষজনক নয়। মোটের উপর এ ছিল এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ; কাজেই এদের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভেদ রেখা টানা কঠিন। তবে একে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা চলে : প্রথম বিজয়ের যুগ (১১৪৪ সাল পর্যন্ত); দ্বিতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার যুগ এবং সালাহ্উদ্দীনের বিরাট বিজয়; তৃতীয়–ছোট ছোট ঘরোয়া যুদ্ধের যুগ (১২৯১ পর্যন্ত)–এ সময় তারা সিরিয়ার মূলভূমি হতে শেষ ঘাঁটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। বিজয়ের যুগ সম্পূর্ণরূপে তথাকথিত দ্বিতীয় ক্রুসেডের (১১৪৭–১১৪৯) আগে পড়ে এবং তৃতীয় যুগ মোটামুটি এয়োদশ শতাব্দীর সাথে মিলে যায়। এই শেষোক্ত যুগের একটি ক্রুসেড পরিচালিত হয় কন্সটানটিনোপলের বিরুদ্ধে (১২০২–১২০৪), দুইটি মিসরের বিরুদ্ধে (১২১৮–১২২১), একটি তিউনিসের বিরুদ্ধে (১২৭০)। এ সব অভিযান নিষ্ফল হয়।
প্রথম ক্রুসেডারগণ কন্সটানটিনোপল হতে এশিয়া মাইনরের পথে যাত্রা করে। ম্রাট আলেকসিয়াস অধিকাংশ ক্রুসেডীয় নেতার নিকট হতে তার প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ক্রুসেডারগণ তাদের বিজয় পথে এশিয়া মাইনরের অর্ধভাগের উপর বাইজেন্টাইন প্রভুত্ব পুনঃস্থাপন করে এবং তুর্কদের ইউরোপ আক্রমণ সাড়ে তিনশ’ বছর পিছিয়ে দেয়।
১০৯৪ সালের মধ্যেই ক্রুসেডারগণ ইডেসা, টারসাস, এনটিওক এবং আলেপ্পা অধিকার করে। যে ‘পবিত্র বর্শা’ ক্রুসোপরি যীশুখৃস্টের দেহকে বিদ্ধ করে এবং যা বহু শতাব্দী পর্যন্ত এনটিওকের একটি গীর্জার তলে সমাহিত ছিল, ক্রুসেডারদের দ্বারা সেই বর্শা আবিষ্কৃত হওয়ায় তাদের উৎসাহ শতগুণে বেড়ে যায়। ১০৯৯ সালের ৭ জুন প্রায় বিশ হাজার নিয়মিত সৈন্যসহ চল্লিশ হাজার ক্রুসেডার জেরুজালেমের সম্মুখে গিয়ে হাজির হয়। এখানে মিসরীয় সৈন্য দলের সংখ্যা ছিল মাত্র এক হাজার। জেরিকোর দেয়াল যেমন ধ্বসে পড়েছিল, জেরুজালেম দেয়ালও তেমনি ধ্বসে পড়বে –এই ভরসায় ক্রুসেডাররা খালি পায় শিঙ্গা ধ্বনি করতে করতে চারপাশ ঘুরে আসে। ১৫ জুলাই আক্রমণকারীরা নগরে প্রবেশ করে এবং নর-নারী ও আবাল-বৃদ্ধ নির্বিশেষে নগরবাসিগণকে কতল করে। শহরের অলিতে-গলিতে ও ভ্রমণ স্থানে স্থূপীকৃতভাবে মানুষের মাথা, হাত ও পায়ের পাতা পড়ে থাকতে দেখা যায়। ক্রুসেডারদের অনেকে তাদের ব্রত সাধিত হয়েছে ভেবে জাহাজে চড়ে দেশে ফিরে যায়।
ফ্রান্সের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কাউন্ট ছিলেন তোলোর রেমন্ড। তিনি ও বোহোন্ড, বলডুইন, গডফ্রে এবং ট্যানক্রেডের নেতৃত্বে ক্রুসেডাররা সিরিয়া ফিলিস্তিনে তিনটি ছোট ল্যাটিন রাজ্য স্থাপন করে এবং আরো রাজ্য স্থাপনে উদ্যোগী হয়। কিন্তু এসব রাজ্য বেশী দিন টিকে নাই। তাদের কলহ-কোন্দলের বিবরণ আরব ইতিহাসের অঙ্গ নয় ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি অধ্যায়। তবে স্থানীয় লোক এবং ইউরোপীয় আগন্তুকদের মধ্যে যে শান্তি ও বন্ধুত্বময় সম্বন্ধ গড়ে ওঠে, তা উল্লেখযোগ্য।
খৃষ্টানরা পবিত্র ভূমিতে এই ধারণা নিয়ে আসে যে, তারা স্থানীয় লোকদের চেয়ে বহু গুণে উন্নত; স্থানীয় লোকেরা প্রতিমা পূজক, তারা হযরত মুহম্মদকে (সঃ) আল্লাহ, জ্ঞানে পূজা করে। প্রথম সাক্ষাতেই তাদের এ ভুল ভেঙ্গে যায়। খৃস্টানরা আরবদের মনে যে ধারণা রেখে আসে, তা একজন আরব ঐতিহাসিকের কথায় পাওয়া যায়? ইউরোপীয় লোকগুলি জন্তু; তবে তাদের সাহস ও লড়াইয়ের ক্ষমতা–এই দুই গুণ আছে; আর কিছুই নাই। স্থানীয় ও আগন্তুকদের মধ্যে যুদ্ধের চেয়ে শান্তির সময় দীর্ঘতর ছিল। এই সময়ে তারা বাধ্য হয়ে পাশাপাশি থাকে; কিন্তু এই বাধ্যতামূলক প্রতিবেশিত্বের ফলে তারা পয়গম্বরকে জানাবার সুযোগ পায়; ফলে তাদের পরস্পরের প্রতি আগের মনোভাব বহুলাংশে বদলে যায়। ক্রমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। ফিরিঙ্গীরা বিশ্বাসভাজন স্থানীয় লোককে ক্ষেত-খামারের কাজে নিযুক্ত করতে থাকে। তারা যে সামন্ততান্ত্রিক প্রথার প্রবর্তন করে, আস্তে আস্ত তা স্থানীয় ভূমি-ব্যবস্থায় স্থান করে নেয়। তারা তাদের সঙ্গে ঘোড়া, বাজ ও কুকুর নিয়ে যায়। অল্পকাল মধ্যেই চুক্তি হয়ে যায় যে, শিকারীদল আক্রমণের বিপদ হতে মুক্ত থাকবে। পথিক ও সওদাগরদের জন্য রক্ষী বদলা–বদলী হত এবং সাধারণতঃ উভয় পক্ষই সত্য রক্ষা করত। ফিরিঙ্গীরা ইউরোপীয় পোশাক ছেড়ে দিয়ে দেশীয় লোকের অধিকতর আরামজনক পোশাক গ্রহণ করে। খাওয়া-খাদ্য ব্যাপারে–বিশেষ করে চিনি ও মসলাযুক্ত খাদ্যের দিকে তাদের নতুন রুচি গড়ে ওঠে। প্রাচ্য ফ্যাশনের বড় বড় কোঠা ও প্রবহমান পানির উৎস-যুক্ত বাড়ীই তারা পছন্দ করতে শুরু করে। কেউ কেউ স্থানীয় লোকের মধ্যে বিয়ে-শাদী করে। এমন ঘরের ছেলে-মেয়েকে বলা হত ‘পুলেইন’-বকরীর বাচ্চা’ অথবা কেবল বাচ্চা। মুসলমান ও ইহুদী উভয়ে ভক্তি করে এমন কোন কোন তীর্থস্থানকে তারা ভক্তি করা আরম্ভ করে। তাদের মধ্যে কলহের অন্ত ছিল না। সে সব কলহে তারা কখনো কখনো বিধর্মীদের সাহায্য চাইত; মুসলমানরাও তাদের দুশমনের বিরুদ্ধে খৃস্টানদের সাহায্য চাইত।