হালাকু খাঁ ছিলেন চেঙ্গীজ খাঁর অন্যতম পৌত্র। ১২৫৩ সালে এক বিপুল বাহিনীসহ হালাকু খিলাফত ধ্বংসের জন্য মঙ্গোলীয়া হতে নির্গত হন। এমনিভাবে মঙ্গোল যাযাবরদের দ্বিতীয় তরঙ্গ এগিয়ে আসতে থাকে। বাগদাদ সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ হতে যে সব ছোট ছোট রাজ্য মাথা তুলে উঠেছিল, হালাকুর সৈন্য প্রবাহে তাদের সবগুলি ভেসে যায় । ১২৫৮ সালের জানুয়ারী মাসে হালাকুর দুর্বার মঙ্গোল তরঙ্গ বাগদাদের প্রাচীরে প্রাচীরে ভেঙ্গে পড়ে। রাজধানীর দেয়াল সে তরঙ্গের অভিঘাত সইতে পারে না; ভগ্নপথে মঙ্গোল প্রবাহ প্রবেশ করে সমস্ত বাধা-বিঘ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হালাকুর একজন খৃস্টান স্ত্রী ছিল; সেই ভরসায় খলীফার উজীর নেস্টোরীয়ান ধর্মযাজককে সঙ্গে নিয়ে হালাকুর শিবির দুয়ারে পৌঁছে সন্ধির শর্ত জিজ্ঞাসা করে পাঠান। কিন্তু হালাকু তাকে সাক্ষাত দান করতে রাজী হন নাই। কেউ কেউ গিয়ে হুঁশিয়ারীর বাণী উচ্চারণ করে বলেন : বাগদাদ শান্তির শহর। অতীতে এ শহর যারা আক্রমণ কিংবা আব্বাসীয় খিলাফত ধ্বংস করতে এসেছে, তারা নিপাত গিয়েছে। কিন্তু হালাকুর মনে ভয়ের রেখাপাত মাত্র হয় না। কেউ কেউ গিয়ে বলে–খলীফাকে হত্যা করলে সমস্ত বিশ্বে বিপ্লব শুরু হবে; সূর্য তার মুখ লুকাবে, বৃষ্টিপাত থেমে যাবে, গাছ-পালার জন্ম বন্ধ হবে। কিন্তু হালাকুর সাথে জ্যোতিষী ছিল এবং তাঁরা তাঁকে জয়ের পক্ষে নিশ্চয়তার পরামর্শ দেয়। হালাকু অবিচলিত থাকেন। দশই ফেব্রুয়ারী তক তার বর্বর অনুচরেরা শহর ভরে ফেলে। হতভাগ্য খলীফা তার তিনশ’ সভাসদসহ এসে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেন। দশ দিন পর তাঁদের সবাইকে হত্যা করা হয়। শহর আগুন আর লুণ্ঠনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। খলীফার পরিবারের লোকজনসহ বেশীর ভাগ বাসিন্দাকেই কতল করা হয়। পথের পাশে পাশে লাশ পচে গলে যায়; তার দুর্গন্ধে হালাকু কয়েক দিনের জন্য শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। বাগদাদে তাঁর বাস করার ইচ্ছা ছিল বলে অন্যান্য বিজিত শহরের মত বাগদাদকে ধ্বংসতূপে পরিণত করা হয় নাই। নেক্টোরীয়ান যাজক-পতি বিশেষ ভাষার অনুশীলন, অনুগ্রহ পান। কয়েকটি মসজিদ এবং মদ্রাসা বেঁচে যায় বা পুনর্নির্মিত হয়। জুমার নামাজে যার নামে খোতবা পড়া চলে, এমন খলিফার অভাব মুসলিম জগতে এই প্রথম দেখা দেয়।
১২৬০ সালে হালাকু উত্তর সিরিয়া আক্রমণে উদ্যত হন। এখানে তিনি হামা, হারিম ও আলেপ্পো দখল করেন। শেষোক্ত শহরে ৫০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়। ইতিমধ্যে তার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ আসে। কাজেই দামেস্ক বিজয়ের জন্য সৈন্য পাঠিয়ে তিনি পারস্যে ফিরে আসেন। তাঁর ফেলে-আসা সৈন্যরা দামেস্ক অধিকার করে। কিন্তু তারপর ১২৬০ সালে নাজারেথের নিকট তারা বায়বার্সের হাতে বিধ্বস্ত হয়। বায়বার্স আরব জগতের শেষ উল্লেখযোগ্য বংশ মামলুকদের কৃতী সেনাপতি ছিলেন।
হালাকুই প্রথম ইল-খান উপাধি গ্রহণ করেন ১৯৬৫ সালে তাঁর মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে হযরত মুহম্মদের (সঃ) ধর্ম আবার এক মহোজ্জ্বল বিজয় লাভ করে : সপ্তম খান ইসলামকে রাষ্ট্রের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন। যেমন মামলুকদের বেলায়, তেমনি মঙ্গোলদের বেলায় মুসলমানদের বাহুবল যেখানে পরাজয় মানে, ইসলাম সেখানে জয়লাভ করে।
ইতিমধ্যে দূর পশ্চিম প্রান্তে ইসলাম আর এক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। এ সঙ্কটের ফলে আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় পৃষ্ঠা যুক্ত হয় এবং ইসলামের এক মহত্তম সেনানী ও বন্ধুর আবির্ভাব ঘটে। এ ছিল ক্রুসেড-আর সালাহউদ্দীনের যুগ।
১৭. ক্রুসেড
ইতিহাসের দূর অতীত হতে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া লক্ষিত হয়, ক্রুসেড তারই মধ্যযুগীয় অধ্যায়। ট্রোজান ও পার্সীয়ান যুদ্ধগুলি ছিল সূচনা। পশ্চিম ইউরোপের এ যুগে এই সাম্রাজ্য বিস্তার তার আধুনিকতম পরিণতি।
আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বলা চলে যে, ৬৩২ সাল হতে মুসলিম এশিয়া সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, স্পেন ও সিসিলী প্রভৃতি ভূভাগে যে আক্রমণমূলক সংগ্রাম পরিচালনা করে, ক্রুসেড তারই বিরুদ্ধে খৃস্টান ইউরোপের প্রতিক্রিয়া। ক্রুসেডের পরিপোষক আরো কতকগুলি পূর্ববর্তী কারণ ছিল; যেমন : টিউটনিক সম্প্রদায়গুলির যাযাবর জীবন ও সগ্রাম প্রবণতা; ইতিহাসে প্রথম আবির্ভাব কাল হতে এরা ইউরোপের মানচিত্র বদলিয়ে দেয়; ১০০৯ সালে একজন ফাতেমীয় খলীফা কর্তৃক বায়তুল মোকাদ্দেসের গীর্জা ধ্বংস;–এখানে হাজার হাজার ইউরোপীয় তীর্থে যেত এবং ৮০০ সালে এর চাবি বায়তুল মোকাদ্দেসের প্রধান পুরোহিত শার্লেমেনকে আশীর্বাদরূপে পাঠান; আর এশিয়া মাইনরের ভিতর দিয়ে যাওয়া কালে তীর্থযাত্রীদের প্রতি জুলুম। কিন্তু ক্রুসেডের আশু কারণ ছিল, বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেকসিয়াস কমনেনাস-এর যুদ্ধ আবেদন। সালজুকদের দ্বারা তার এশিয়াস্থ মর্মরার উপকূল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়। তারা কন্সটানটিনোপলের উপর পর্যন্ত হামলা করতে ব্ৰতী হয়। এই অবস্থায় সম্রাট ১০৯৫ সালে পোপ দ্বিতীয় আরবানের নিকট আবেদন করেন। মনে হয়, পোপ এই আবেদনের সুযোগ নিয়ে গ্রীক চার্চ ও রোমক চার্চের মধ্যে ঐক্যবিধানের আশা পোষণ করছিলেন; কারণ, উভয়ের ভিতরকার মতবাদমূলক বিভেদ ইতিপূর্বেই ১০০৯ ও ১০৫৪ সালের মাঝখানে দূরীভূত হয়েছিল।