আর একটি স্বতন্ত্র বংশ দুইশ’ বছরের উপর শাসন পরিচালনা করে এবং ইতিহাসে একটা পাতা যোগ করে। এদের দিকে এখন আমাদের মনোযোগ দিতে হয়। এ ছিল ফাতেমীয় খলীফাদের বংশ-মুসলিম-জগতে একমাত্র উল্লেখযোগ্য শীয়া খিলাফত। বাগদাদের খলীফারা মুসলিম-জগতের যে নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিল, তারই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ৯০৯ সালে তিউনিসে এর প্রতিষ্ঠা হয়। অল্পকাল মধ্যেই এরা মিসর ও সমগ্র উত্তর আফ্রিকার উপর আধিপত্য স্থাপন করে এবং তাদের অধীনে কায়রো শহর নব গৌরব মহিমায় উন্নীত হয়। কিন্তু সাময়িকভাবে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও এরা দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে নাই। নীলনদের যে পানি তীর ছাপিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত, তারই উপর বাসিন্দারা তাদের রুটির জন্য নির্ভরশীল ছিল; সুতরাং তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল একান্ত অনিশ্চিত। দুর্ভিক্ষ, প্লেগ ও খাজনা আদায়কারীদের অত্যাচার, ষড়যন্ত্র ও অনাচারের সেই পুরানো কাহিনী–সমস্ত মিলে ফাতেমীয়দের দুর্বল করে ফেলে। ক্রুসেডের আমলে ১১৭১ সালে বিশ্ব বিখ্যাত সালাহউদ্দীন এ খিলাফতের অবসান করেন।
রাজনৈতিক দিক হতে ফাতেমীয় বংশ মিসরে এক নতুন যুগের সূচনা করে। ফেরাউনদের পর মিসর এই প্রথম একটা সার্বভৌম এবং জীবন্ত শক্তির অধীশ্বর হয়। একজন পারসিক মিশনারী ১০৪৬–১০৪৯ সালে মিসরে ভ্রমণ করতে আসেন এবং উচ্চ প্রশংসাপূর্ণ একটি বিবরণ রেখে যান। খলীফার প্রসাদে ৩০ হাজার লোক থাকত; তার মধ্যে চাকর ছিল ১২ হাজার, অশ্বারোহী এবং পদাতিক ১০ হাজার। ভ্রমণকারী একদা এক উৎসব উপলক্ষে তরুণ খলীফাকে দেখেন। তিনি একটি খচ্চরের উপর সওয়ার ছিলেন। চেহারাটি সুন্দর দাড়ি ছাটা। পরনে কেবল একটি সাদা জামা আর পাগড়ী–তাঁর মাথার উপর প্রসারিত বহু মূল্য রত্ন খচিত ছত্র। রাজধানীতে খলীফার ২০ হাজার বাড়ী ছিল–বেশীর ভাগই ইটে তৈরী ও পাঁচ হতে ছয় তলা। তার দোকানও অনুরূপ সংখ্যক ছিল; প্রত্যেক দোকান মাসে দুই হতে দশ দিনার হারে ভাড়া দেওয়া হত। প্রধান রাস্তাগুলির ছাদ ও ছাদের নীচে বাতি ছিল। দোকানদাররা একদামে জিনিস বিক্রি করত। কোন দোকানদার গ্রাহককে ঠকালে তাকে উটে চড়িয়ে ঘন্টা বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরানো হত আর অপরাধী অনবরত তার অপরাধ স্বীকার করতে থাকত। এমন কি মনিকার ও বাট্টাদারদের দোকানও খোলা রেখে যাওয়া হত। সমস্ত দেশব্যাপী এমন নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি ভ্রমণকারীর নজরে পড়ে যে, তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, আমি এ দেশের ধন-সম্পদের কোন পরিমাণই করতে পারলাম না। আমি আর কোথাও এত সমৃদ্ধির নিদর্শন দেখি নাই।’
ফাতেমীয়রা যখন মিসর ও উত্তর আফ্রিকায় আধিপত্য বিস্তার করে, তখন বাগদাদের পুরানো সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন ধরে। সালজুক তুর্করা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এবং তুগরীল নমে তাদের একজনকে ১০৩৭ সালে রাজধানীতে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে। নতুন নতুন তুর্কী উপজাতীয় কওমের লোক এসে এদের সৈন্যদল পুষ্ট করতে থাকে। সালজুকরা তাদের রাজ্যও চারদিকে বাড়াতে থাকে। আবার পশ্চিম এশিয়া এক সাম্রাজ্যে একীভূত হয় এবং ইসলামের বাহু বলের বিলীয়মান গৌরব ফিরে আসে। ইসলামের বিশ্ব-নেতৃত্বের সগ্রামে মধ্য এশিয়া হতে এক নতুন জাতি এসে রক্তের খেলায় মেতে ওঠে। এই বর্বর অবিশ্বাসীরা কি করে পয়গম্বরের অনুচরদের ঘাড়ে পা রাখে–আবার তাদেরই ধর্ম গ্রহণ করে সে ধর্মের একনিষ্ঠ রক্ষক হয়ে দাঁড়ায়, ইসলামের বিচিত্র ইতিহাস তার কাহিনী নতুন নয়। তাদেরই জ্ঞাতি এয়োদশ শতাব্দীর মঙ্গোলরা এবং তাদের অন্য জ্ঞাতি চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের ওসমানীয় তুর্করা তো এই একই কাজের পুনরাবৃত্তি করে। রাজনৈতিক ইসলামের সর্বাপেক্ষা দুর্দিনে ধর্মীয় ইসলাম তার কতিপয় শ্রেষ্ঠতম বিজয় অর্জন করে।
ইসলামের আসমানে সত্যি তখন ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। ১২১৬ সালে চেঙ্গীজ খ ষাট হাজার দুর্ধর্ষ মঙ্গোল যোদ্ধার এক ভয়াবহ বাহিনী নিয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অদ্ভুত ধনুক হাতে চারিদিকে ত্রাস সৃষ্টি আর নিষ্ঠুর ধ্বংসের আগুন জ্বালাতে বের হন। এদের হামলার তাণ্ডবে প্রাচ্য ইসলামের তামদুনিক কেন্দ্রগুলির অস্তিত্ব মুছে যায়; তাদের স্থান রয়ে যায় উষর নির্মম মরুভূমি; অথবা যেখানে ছিল মস্ত বড় বড় ইমারত ও কুতুবখানা, সেখানে পড়ে থাকে বিকট ধ্বংসস্তূপ। তাদের পেছনে লোহিত দাগ রেখে চলে বিশুষ্ক রক্ত প্রবাহ। হিরাটের ১ লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে বেঁচে যায় মাত্র ৪০ হাজার। বোখারার সুবিখ্যাত মসজিদগুলিকে বর্বররা তাদের ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে। বলখ ও সমরকন্দের বাসিন্দাদের অধিকাংশকে নির্মমভাবে হত্যা করে অবশিষ্টদের বন্দী করে নেয়। খাওয়ারিজমকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। শীঘ্রই বাগদাদের পালা আসে। বোখারা দখল করে নাকি চেঙ্গীজ খ ঘোষণা করেন : আমি আল্লাহর গজব, পাপীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি। যে লোকদের তিনি পরিচালন করেন, তারা ব্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চীন হতে আদ্রিয়াতিক পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগ ওলোট পালোট করে তোলে। রাশীয়া আংশিকভাবে অধিকৃত হয় এবং তারা মধ্য ইউরোপের পূর্ব শীয়া পর্যন্ত প্রবেশ করে। ১২৪১ সালে চেঙ্গীজ খাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারীর মৃত্যু হয় বলে পশ্চিম ইউরোপ মঙ্গোল হামলাকারীদের হাত হতে বেঁচে যায়। কিন্তু বাগদাদের রেহাই ছিল না।