কিন্তু ফ্রেডারিকের একক মহত্তম অবদান ছিল তার নেপলস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা (১২২৪)। সুস্পষ্ট সনদ অনুসারে স্থাপিত এই-ই ছিল ইউরোপের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে তিনি সংগৃহীত বহু আরবী পাণ্ডুলিপি মওজুদ করেন। আরাস্তু ও ইবনে রুশদের গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য করেন। এই অনুবাদের কপি তিনি প্যারিস ও বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন টমাস একুইনাস। চতুর্দশ শতাব্দী হতে শুরু করে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্যারিস, অক্সফোর্ড প্রভৃতি ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী অধ্যয়নের ব্যবস্থা ছিল; কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ আলাদা–মুসলিম দেশসমূহের জন্য মিশনারী তৈরী করা।
সিসিলী দুই সাংস্কৃতিক অঞ্চলের মিলনভূমি হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় জ্ঞান আদান-প্রদানের এক অপূর্ব মাধ্যমে পরিণত হয়। এর বাসিন্দাদের মধ্যে কতক ছিল জাতিতে গ্রীক, তারা গ্রীক ভাষায় কথাবার্তা বলত; কিছুসংখ্যক ল্যাটিন জানা পণ্ডিত ছিল। এ তিনটি ভাষাই সরকারী কাগজে, রাজকীয় সনদে এবং পালারমোর জনসাধারণের কথা-বার্তায় ব্যবহৃত হত।
সিসিলীর নর্মান রাজারা তাদের পরবর্তীদেরসহ কেবল সিসিলী নয়, দক্ষিণ ইটালীও শাসন করতেন। এইরূপে সিসিলী হতে মুসলিম সংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণ সমগ্র ইটালী ও মধ্য ইউরোপে যাওয়ার জন্য তারা সেতু-বন্ধ স্বরূপ ছিলেন। দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত আল্পস পর্বতের উত্তর অঞ্চলে মুসলিম তমনের স্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। দান্তের পরলোক সম্বন্ধীয় ধারণা কোন নির্দিষ্ট আরবী বই থেকে না নেওয়া হতে পারে, কিন্তু একথা নিশ্চিতই মনে হয় যে, সে ধারণার মূল ছিল প্রাচ্য দেশে, যদিও কবি তা ইউরোপীয় লোক-কাহিনী হতে গ্রহণ করেন। প্রাচ্য দেশ হতে নানা পথে এই অনুপ্রবেশ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয় ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে। সিসিলী ও ইটালীর দক্ষিণ ভাগ খৃস্টান শাসনে চলে যাওয়ার বহুদিন পরেও মুসলিম কারিগর ও শিল্পীদের আদর ছিল। প্যালেটাইন চ্যাপেলে তাদের মোজাইক ও লিপি-শিল্পই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। পালারমো রাজপ্রাসাদে মুসলিম শাসকরা যে বিখ্যাত বয়ন-শিল্পাগার স্থাপন করেন, তা হতে উৎপন্ন সূক্ষ্ম কাপড় (আরবী লিপি-শিল্পের অলংকারসহ) ইউরোপীয় রাজপরিবারসমূহের পোশাকের অভাব পূরণ করত। প্রাচ্যে বোনা কাপড়ের চাহিদা এত প্রবল ছিল যে, তার অন্ততঃ এক প্রস্থ না থাকলে কোন ইউরোপীয় ভদ্রলোকই স্বস্তিবোধ করতেন না।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভেনিস অত্যন্ত ক্ষিপ্ততার সঙ্গে মুসলিম ফ্যাশন গ্রহণ ও চারদিকে বিস্তার করতে থাকে। এই সময় ইটালীর দফতরিখানায় বাধা এই আরবী চেহারা গ্রহণ করতে শুরু করে। আরব দফতরিদের বাঁধানো বইয়ে পাতার সামনের প্রান্ত রক্ষার জন্য ফ্ল্যাপ থাকত। খৃষ্টানদের বইয়ে এই ফ্ল্যাপসহ আরব বাঁধাইয়ে অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়। সেই সঙ্গে চামড়ার খাপ কারুকার্য খচিত করার বিদ্যাও ইটালীর বিভিন্ন শহরের মুসলিম কারিগরদের নিকট হতে শিক্ষা করা হয়। ভেনিস আরো একটি আরব-শিল্পের কেন্দ্র ছিল পিতলের উপর সোনা, রূপা অথবা লাল তামার কাজ। মুসলিম সংস্কৃতি বিস্তারে স্পেনের পরই সিসিলীর স্থান এবং ক্রুসেডের যুগে তার স্থান ছিল সিরিয়ার উপরে।
মুসলমানদের শেষ চিহ্ন যখন ইউরোপের বুক হতে মুছে যাচ্ছিল, তখন বাগদাদের খিলাফত ষড়যন্ত্র ও রক্তপাতের দরীয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে। এর পরের অবস্থা কি হবে এবং কোন্ পথে সে নতুন অবস্থার আগমন ঘটবে, নবম শতাব্দীতে তুলুনিদ বংশের প্রতিষ্ঠায় তার আংশিক পরিচয় পূর্বাহ্নেই পাওয়া যায়। খিলাফতের বুকের মধ্যে যে তুর্করা বাসা বেঁধে এতকাল নীরব ছিল, এ বংশের প্রতিষ্ঠায় তাদেরই রাজনৈতিক আশা-আকাক্ষা দানা বেঁধে ওঠে। এরপর আরো শক্তিশালী তুর্ক বংশ রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়। খিলাফতের ধ্বংসের উপর যে সব রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তার মধ্যে আহমদ ইবনে তুলুন-এর রাজ্য অন্যতম। আহমদ ৮৬৮ সালে ক্ষমতা হস্তগত করেন। এইসব রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্বন্ধ সম্পূর্ণ রকমে ছিন্ন করে এবং কেবল নামেমাত্র বাগদাদের খলীফার আনুগত্য স্বীকার করতে থাকে। কোন উচ্চাভিলাসী অধীনস্থ কর্মচারী তার আপন বাহুবলে এবং গোলাম ও অনুচরদের সাহায্যে অমন বিরাট রাজ্যের বুকে কি করে সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে প্রভুত্ব স্থাপন করতে পারে, আহমদ তার প্রমাণ। কিন্তু যে রাজ্যের উপর তুলুনিদ ও দ্রুপ অন্যান্য বংশ শাসন-ক্ষমতা পরিচালন করত, সে রাজ্যের ভিতর তাদের জাতীয় ভিত্তি ছিল না। তাদের দুর্বলতার মূল ছিল, রাজ্যে তাদের স্বজাতীয় ঐক্যবদ্ধ কোন দলের সমর্থনের অভাব। শাসকরা ছিল অনধিকার প্রবেশকারী। তাদের দেহ রক্ষীরাই ছিল তাদের সৈন্য এবং এ দেহরক্ষীদের তারা বাইরের বিজাতীয়দের মধ্য হতে সংগ্রহ করত। কেবল অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকই এমন শাসন চালাতে পারে। এদের সবল বাহু দুর্বল হয়ে পড়া মাত্রই চারদিকে ভাঙ্গন শুরু হয়। ইবনে তুলুন যে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন, তা রাজ্যের চতুর্থ উত্তরাধিকারী তার পুত্রের আমলে ৯০৫ সালে আব্বাসীয় খলীফাদের হাতে ফিরে যায়।