সিসিলী দ্বীপ নর্মানদের অধীনে থাকাকালে সেখানে খৃস্টান ও মুসলমানদের কৃষ্টির সংমিশ্রণে এক নতুন তমদ্দুনের উদ্ভব হয়। সিসিলী আগে হতেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনে সমৃদ্ধ ছিল। আরব শাসনাধীনে থাকাকালে প্রাচ্য সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা এখানে প্রবেশ করতে থাকে এবং আগের জামানার গ্রীক ও রোমক সভ্যতার নিদর্শনের সঙ্গে মিশে গিয়ে নর্মানদের আমলে নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করে এবং নর্মান সংস্কৃতি এক সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যে ফুটে ওঠে। এতকাল পর্যন্ত আরবরা যুদ্ধ-বিগ্রহে এমন গভীরভাবে লিপ্ত ছিল যে, তারা শান্তি কালোপযোগী কোন শিল্পের বিকাশ সাধন করার অবকাশ পায় নাই। এক্ষণে তাদের প্রতিভা আরব শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অপূর্ব সাফল্য সম্পদে ফুটে উঠল।
প্রথম রোজার নিজে অশিক্ষিত খৃষ্টান ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বেশীর ভাগ পদাতিক সৈন্য মুসলমানদের মধ্য হতে সংগ্রহ করেন। তিনি আরব জ্ঞান বিজ্ঞানে উৎসাহ দিতেন, প্রাচ্য দেশীয় দার্শনিক, জ্যোতিষী এবং চিকিৎসক দ্বারা পরিব্রত থাকতেন এবং অখৃস্টানদের আচার অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা দিতেন। ফলে মনে হত, পালারমোর দরবার মুখ্যত : প্রাচ্যদেশীয় এবং গৌণতঃ পাশ্চাত্যদেশীয় ছিল। এর একশত বছরেরও পর সিসিলীতে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যেত ও দেখা যেত, এ খৃস্টান রাজ্যের কতকগুলি উচ্চতম পদে অধিষ্ঠান করছে মুসলমান কর্মচারী।
ইউরোপ মহাদেশে প্রাপ্ত কাগজে-লিখিত প্রাচীনতম দলীল হচ্ছে গ্রীক ও আরবীতে লেখা একটি হুকুমনামা। সম্ভবতঃ ১৯০৯ সালে প্রথম রোজারের পত্নী এই আদেশ জারী করেন। মনে হয়, এ কাগজ সিসিলীতে উৎপাদিত হয় নাই সিসিলীর আরবরা প্রাচ্য দেশ হতে আমদানী করে।
প্রথম রোজার যে আরব-সিসিলীর মৈত্রীর সূচনা করেন, তার পূর্ণ বিকাশ দেখা যায় তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় রোজার (১১৩০-১১৫৪) এবং দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের মধ্যে। দ্বিতীয় রোজার মুসলমানের মত পোশাক পরতেন। তার সমালোচকরা তাকে বলত “আধা-বিধর্মী রাজা’। তার পোশাকে পূর্ণাঙ্গ আরবী সাজ-সজ্জার বৈশিষ্ট্য ছিল। এমনকি তাঁর পৌত্রের আমলেও একজন ভ্রমণকারী পালারমোর মহিলাগণকে মুসলিম পোশাক পরতে দেখে।
দ্বিতীয় রোজারের দরবারের প্রধান অলঙ্কার ছিলেন আল-ইদরিসী। সমস্ত মধ্যযুগের মধ্যে তাঁর মত কৃতী ভৌগোলিক ও মানচিত্রবিদ আর একজনও ছিলেন না। তার পুরানাম ছিল আরু আবদুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে মুহম্মদ আল ইদরিসী। ১১০০ সালে সিউটার এক স্পেনীয় আরব পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। দ্বিতীয় রোজারের পৃষ্ঠপোষকতায় পালারমো শহরে থেকে তিনি তার জীবনব্যাপী সাধনা করেন। তাঁর রোজারীয় গ্রন্থে তিনি টলেমী, আল-মাসুদী প্রমুখ ভৌগোলিকদের মতের সংক্ষিপ্ত সার দিয়েই তুষ্ট হন নাই; বরং যে সব লোক তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশে প্রেরিত হয়, তাদের প্রদত্ত মূল বিবরণের উপরই প্রধানতঃ নির্ভর করেন। এই সব তথ্যের তুলনমূলক আলোচনা ও বিশ্লেষণে তিনি দৃষ্টির অসামান্য প্রসারতা প্রদর্শন করেন এবং পৃথিবী যে গোল, তা’ এবং দ্রুপ বহু মৌলিক তত্ত্ব-জ্ঞানের পরিচয় দেন। তিনি নীলনদের উৎপত্তি স্থান নির্দেশ করেন, যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে এ তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ গ্রন্থ তাঁর এক অমর কীর্তি। এছাড়া তিনি তার নর্মান পৃষ্ঠপোষকের জন্য রূপ দিয়ে মহাশূন্যের একটি ম্যাপ ও পৃথিবীর একটি ম্যাপ তৈরী করেন। সিসিলীর দ্বিতীয় ‘খৃস্টান-সুলতান ছিলেন দ্বিতীয় রোজাবের পৌত্র হোহেনস্টফেনের দ্বিতীয় ফ্রেডারিক। তিনি সিসিলী ও জার্মানী উভয় দেশই শাসন করতেন। ১২২০ সালের পর তিনি পবিত্র রোমক সম্রাজ্যের অধিপতি’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং ব্রিয়েনের ইসাবেলাকে বিয়ে করে বায়তুল মোকাদ্দেসের রাজা হন। সুতরাং, ধর্মের বিষয়াদির বাইরে সম্রাট ফ্রেডারিক খৃস্টজগতের উচ্চতর ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এই বিয়ের তিন বছর পর তিনি এক ক্রুসেডে বের হন। এর ফলে ইসলামী আদর্শে তিনি আরো প্রভাবান্বিত হন।
ব্যক্তিগত ও সরকারী জীবনে ফ্রেডারিক অর্ধ-প্রাচ্যপন্থী ছিলেন। তিনি হেরেম প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দরবারে দীর্ঘ দাড়ি ও দোলায়মান পোশাক নিয়ে সিরিয়া ও বাগদাদের দার্শনিকরা বিরাজ করত, প্রাচ্যদেশ হতে নর্তকী বালিকা এসে হাজির হত, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় অঞ্চল হতে ইহুদীরা আসত। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্বন্ধ সূত্রে তিনি মুসলিম জগত-বিশেষতঃ মিসরের সুলতানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে চলতেন। সূর্য কিরণে উটপাখীর আণ্ডা ফুটানোর পন্থা পরীক্ষা করার জন্য তিনি মিসর হতে বিশেষজ্ঞ আনেন। সিরিয়া হতে তিনি দক্ষ বাজপালক এনে উক্ত পাখীকে শিকার শিক্ষা দেওয়ার কাজ পর্যবেক্ষণ করেন এবং বাজের চোখ পরীক্ষা করে বুঝতে চেষ্টা করেন যে, বাজ কেবল গন্ধের সাহায্যে তার খাদ্য খুঁজে বের করতে পারে কিনা। থিওড়ো এনটিওক একজন জোকোবাইট খৃস্টান ছিলেন। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র জানতেন এবং ফ্রেডারিকের দোভাষীর কাজ করতেন। সম্রাটের আদেশে তিনি বাজপাখী দ্বারা শিকার সম্বন্ধীয় বই লেখেন। এই-ই ছিল প্রকৃতির ইতিহাস বিষয়ক প্রথম আধুনিক পুস্তক। থিওডোরের আগে মাইকেল স্কট ফ্রেডারিকের দরবারের জ্যোতিষী ছিলেন। ১২২০ হতে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম-স্পেনের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বন্ধে তিনি বিশেষজ্ঞ বলে গণ্য হতেন। ম্রাটের জন্য স্কট আরবী হতে ইবনে সিনার ভাষ্য সম্বলিত আরাস্তুর শরীর-তত্ত্ব ও পশু-পাখী তত্ত্ব সম্বন্ধীয় বইয়ের অনুবাদ করে বইখানি সম্রাটের নামে উৎসর্গ করেন। এই অনুসন্ধান শৃহা এবং এই পরীক্ষামূলক নীতি ও গবেষণা ফ্রেডারিকের দরবারের বৈশিষ্ট্য ছিল আর এখান হতেই ইটালীর রেনেসার সূচনা হয়।