আল-হামরা প্রাসাদে হিস্পনো-মুসলিম রূপসজ্জার চরম উন্নতির পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রানাডার এই অ্যাপলিসটি বিরাট আকারে নির্মিত এবং মোজাইক ও উল্কীর্ণ বচনে ব্যাপকভাবে সজ্জিত হয়। জনৈক নাসরিদ সুলতান ১২৪৮ খৃস্টাব্দে এর পত্তন করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
পাশ্চাত্য মুসলিম স্থাপত্যে ঘোড়র নালের আকারের খিলান এই স্থাপত্যের স্বাভাবিক লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য নিকট প্রাচ্যে ইসলামের আগেও এ স্থাপত্য রীতির চল ছিল। ঘোড়ার গোলাকার নাল আকারে এ রীতি দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে ব্যবহৃত হয়। এই শেষোক্ত রীতি স্পেনে মুরীশ খিলান’ নামে পরিচিত হয়। আরব বিজয়ের আগেও স্পেনে এ রীতি নিঃসন্দেহ রকমে বিদ্যমান ছিল; তবে স্পেনীয়–বিশেষ করে কর্ডোভার মুসলমানরা এর গঠন ও আলংকারিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করে জনসাধারণের মধ্যে এর প্রচলন করে। আরব অধ্যুষিত কর্ডোভার স্থপতিরা ইউরোপের ভাণ্ডারে আরো কতিপয় মৌলিক দান করে। স্থাপত্য বিদ্যার এইসব নব নব বৈশিষ্ট্য মোজারাবদের দ্বারা কর্ডোভা হতে টলেডো এবং উপদ্বীপের উত্তর অঞ্চলের কেন্দ্রে কেন্দ্রে নীত হয়। এখানে মুসলিম ও খৃস্টান রীতির মিলন হতে এক নবতি জন্মলাভ করে। ঘোড়ার নীল আকারে খিলান ও খিলান করা ছাদ এই রীতি র প্রায় অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ছিল। মুদেজার মিস্ত্রীদের হাতে এই রীতি যথেষ্ট উন্নত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে স্পেনের জাতীয় রীতি হিসেবে গণ্য হয়।
গ্রানাডার পতনের বহুকাল পর পর্যন্ত মুরীয় নর্তক ও গায়কগণ স্পেন ও পর্তুগালের জনসাধারণকে আনন্দ বিতরণ করে। রাইবেরার ইদানিং যে গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, কেবল স্পেনের নয়–সমস্ত দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপে ত্রয়োদশ শতাব্দী ও তার পরের সাধারণ সঙ্গীত, সে অঞ্চলের গীতি কবিতা ও ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত আন্দালুসীয়া হতে উদ্ভুত এবং তার আগে তা আরবী মারফত পারসিক, বাইজেন্টাইন ও গ্রীক মূল হতে আসে। দর্শন, গণিত ও চিকিৎসাশাস্ত্র যেমন গ্রীস ও রোম হতে যায় বাইজেনটিয়াম, পারস্য এবং বাগদাদে–আবার বাগদাদ হতে যায় স্পেনে এবং স্পেন হতে যায় সমস্ত ইউরোপে, তেমনিভাবে সঙ্গীতের তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কিত কতিপয় বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে।
স্পেন বাদেও ইউরোপের মধ্যে একমাত্র সিসিলীতে মুসলমানরা শক্তভাবে আসন গেড়ে বসে। ৬৫২ সাল হতে সিসিলীতে মাঝে মাঝে আক্রমণ চলতে থাকে। ৮২৭ সালে এর বিজয় শেষ হয়। এরপর ১৮৯ বছর পর্যন্ত দুর্দান্ত আরব আমীরদের অধীনে সিসিলী আংশিক বা মোল আনা রকমে আরব জগতের একটি প্রদেশ হয়ে থাকে। এর রাজধানী ছিল পালারমা।
উত্তর অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা ও অস্থায়ী বিজয়ের যেমন স্পেন ঘাঁটি বিশেষ ছিল ইটালী সম্পর্কে সিসিলীয় তেমনি ঘাঁটি ছিল। আমীর দ্বিতীয় ইব্রাহীম তিউনিসিয়া হতে আগত আগলাৰী ছিলেন। তিনি সিসিলীও শাসন করতেন। ৯০২ সালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি জেহাদ করতে করতে প্রণালী পার হয়ে ইটালীর পায়ের আঙ্গুল কেলাবরিয়া পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেন। ইনিই কিন্তু প্রথম আরব আক্রমণকারী ছিলেন না। পালারমো অধিকার করার অল্পকাল পরেই উত্তর আফ্রিকার অন্য আগলাৰী সেনাপতিরা দক্ষিণ ইটালীর প্রতিদ্বন্দ্বী লর্ডদের কলহে হস্তক্ষেপ করে। তখনো ইটালীর গোড়ালী ও পায়ের আঙ্গুল বাইজেন্টাইনদের অধীনে। ৮৩৮ সালে যখন নেপলস আরব সাহায্যের জন্য আবেদন করে, তখন আরবদের যুদ্ধধ্বনি ভিসুভিয়াসের প্রান্তভূমি পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলে। এর প্রায় চার বছর পর আদ্রিয়াতিকের তীরে অবস্থিত বারী মুসলমানরা অধিকার করে বসে। এরপর প্রায় ত্রিশ বছর পর্যন্ত এই বারী ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘাঁটি। প্রায় এই সময়ই বিজয়ী মুসলমানরা ভেনিসের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। ৮৪৬ সালে একদল আরব সৈন্য রোম আক্রমণে উদ্যত হয়। ওসটীয়াতে এই সৈন্যদল অবতরণ করে এবং রোমের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়ে ভ্যাটিকানের পার্শ্ববর্তী সেন্টপিটার গীর্জা ও প্রাচীরের বাইরের সেন্টপল গীর্জা পুড়িয়ে দেয়। তিন বছর পর একটি মুসলিম নৌ বাহিনী ওসটীয়াতে পৌঁছে; কিন্তু ঝটিকা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্র ও ইটালীর নৌ বাহিনীর প্রতিরোধের সামনে বিধ্বস্ত হয়। র্যাফেলের একটি চিত্রে এই নৌ যুদ্ধ ও রোমের বিস্ময়করভাবে উদ্ধারের কাহিনী রঙের ভাষায় বর্ণিত আছে। কিন্তু ইটালীর উপর মুসলমানদের প্রভাব এমনি অপ্রতিহত হয় যে, পোপ অষ্টম জন (৮৭২-৮৮২) দুই বছর পর্যন্ত তাদের কর দেওয়া সমীচীন বোধ করেন।
আগলাবীরা ইটালীর উপকূলে অভিযান করেই ক্ষান্ত হয় নাই। ৮৬৯ সালে তারা মালটা দখল করে। দশম শতাব্দীতে ইটালী ও স্পেন হতে আল্পস পর্বতের ভিতর দিয়ে মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত লুণ্ঠন চলতে থাকে। আল্লাস পর্বতমালায় কতকগুলি দুর্গ ও দেয়াল আছে; পর্যটকদের পথনির্দেশ পুস্তকে বর্ণিত তথ্য (টুরিস্ট গাইড) অনুসারে এগুলি আরব আক্রমণের ফল। সুইজারল্যান্ডের ‘গ্যাবী’, ‘আলগ্যাবী প্রভৃতি কতকগুলি স্থানের নাম বোধহয় আরবী হতে উদ্ভূত।
৮৭১ সালে খুস্টানদের দ্বারা বারী’র পুনর্দখল মুসলমানগণ কর্তৃক ইটালী ও মধ্য ইউরোপে আক্রমণ আশঙ্কার সমাপ্তির সূচনা করে। বারীতে সেনাপতিরা এতদূর যায় যে, তারা পালারমোর আমীরের আনুগত্য অস্বীকার করে নিজেদের স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করে। ৮৮০ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট ১ম বেসিল মুসলমানদের নিকট হতে টারানটো কেল্লা পুনর্দখল করেন এবং তার কয়েক বছর পর কালাত্রিয়া হতে অবশিষ্ট আরবগণকে বহিষ্কৃত করেন। আড়াইশ’ বছর আগে সুদূর আরবে যে বিস্তৃতি শুরু হয়েছিল, এইরূপে তার সমাপ্তি ঘটে। যে সব আরব স্তম্ভ’ হতে সিসিলী বা আফ্রিকার আরব নৌ-বাহিনীর আগমন বার্তা ঘোষণা করা হত, আজো তা নেপলস-এর দক্ষিণ অঞ্চলে উপকূল ভাগের সৌন্দর্য বর্ধন করছে। ট্যানক্রেড-দ্য-হটেভিলের পুত্র কাউন্ট রোজার ১০৬০ সালে মেসিনা অধিকার করেন। এইরূপে নর্মানদের দ্বারা সমগ্র সিসিলী দখলের সূচনা হয়। ১০৭১ সালে পালারমো এবং ১০৮৫ সালে সিরাকিউস অধিকৃত হয়। ১০৯১ সালে অধিকার-কার্য সমাপ্ত হয়। ১৯৯০ সালে রোজার মালটা দখল করেন। মূল ভূখণ্ডে আগেই নর্মানদের একটা শক্তিশালী রাজ্য ছিল; এই বার তারা তাদের নব-বিজিত দেশ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়।