ইরাক ও বৃহত্তর সিরিয়াসহ পারস্য উপসাগর হতে সিনাই পর্যন্ত ভূখণ্ডকে “উর্বর হেলাল’ বলা হয়। আরব যেমন সেমিটিক জাতিসমূহকে দিয়েছিল তাদের আদিম বাসভূমি, উর্বর হেলাল তেমনি তাদের দিয়েছিল তাদের প্রাথমিক সভ্যতার সূতিকাগার। সেমিটিক-জাতিরা খৃস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইউফ্ৰেতীস নদীর উপত্যকায় চলে আসে এবং এইখানেই ব্যাবিলোনীয় সংস্কৃতির প্রথম বিকাশ ঘটে। এই সংস্কৃতির অবদান হিসেবেই আমরা পেয়েছি ওজন ও সময় পরিমাপক বিদ্যা। এর এক হাজার বছর পর আমোরাইটরা উত্তর সিরিয়ায় চলে যায়। এদেরই একাংশের নাম ছিল ক্যানানাইট। গ্রীকরা ক্যানানাইটদের বলত ফিনিশীয়ান। এরা লেবাননের উপকূল-ভূমিতে বাস করত। পরে এরাই হয়ে ওঠে জগতের প্রথম উপনিবেশ স্থাপনকারী ও প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী। যদি এরা জগতকে কেবল মাত্র হরফ দিয়ে থাকে, তবে শুধু সেই জন্যেই এদের মানব জাতির মহত্তম বন্ধুদের মধ্যে গণ্য করতে হবে।
আরবের মুসলমানের তাদের বিস্ময়কর বিজয়ের ফলস্বরূপ আরমিনীয়দের (সিরিয়া) মারফত এই প্রাচীন সেমিটিক জাতিসমূহের উত্তরাধিকার লাভ করে। দক্ষিণ আরবের সংস্কৃতিও তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। ইয়েমনে মিনিয়ান, সেবীয়ান ও হিমারাইট গোষ্ঠির মানুষেরা ঐশ্বর্যশালী রাজ্যের পত্তন করে এবং খৃষ্টপূর্ব ১২০০ সাল হতে খ-পরবর্তী : ৫২৫ সাল পর্যন্ত এ সব রাজ্য স্থায়ী থাকে। নামেই বোঝা যায়, শেবার রাণীর আদি বাসভূমি ছিল দক্ষিণ-আরব।
০২. আদিম আরব বেদুঈন
এ-পুস্তকে আরবী ভাষাভাষী সমস্ত জাতিই আমাদের আলোচ্য বিষয় কেবল আরবের বাসিন্দা নয়–সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ট্রান্স জর্দান, ইরাক, ইরান, মিসর, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যযুগীয় সিসিলী ও স্পেন সহ বহু দেশের লোক। তথাপি আদিম আরব বেদুঈনের উপর আমাদের প্রথম আলোক সম্পাতের প্রয়োজন।
জিপসীরা কেবল বেড়ানোর জন্যই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। বেদুঈন সে ধরনের জিপসী নয়। মরুভূমির অবস্থার সঙ্গে মানুষের জীবনকে কি করে সব চেয়ে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে চলতে হয়, বেদুঈন তার প্রকৃষ্ট আদর্শ। যেখানে ঘাস জন্মে, বেদুঈন তার উট, ঘোড়া, দুম্বা, বকরীর খাদ্যের খোঁজে সেখানেই চলে যায়। ডেট্রয়েট অথবা ম্যানচেস্টারে শিল্প ব্যবসায়ের মত নফুয়ে যাযাবর বৃত্তি জীবনযাত্রার এক বিজ্ঞানসম্মত পথ। বেদুঈনকে তার প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে একটা সুসঙ্গত এবং কঠোর সামঞ্জস্য সাধন করে চলতে হয়। কারণ, আরবের প্রায় সর্বাংশেই মরুভূমি; বাস-উপযোগী কেবল একটি মরু-ভূখও তার চারদিকে ঘিরে আছে। আরবরা তাদের দেশকে দ্বীপ বলে। প্রকৃতপক্ষে আরব একটি দ্বীপ। তার তিন দিকে পানি আর চতুর্থ দিকে বালির দরিয়া।
আরব পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বড় উপদ্বীপ। এত বড় আয়তন সত্ত্বেও এর বাসিন্দা সংখ্যা সত্তর-আশী লাখের বেশি নয়। ভূতত্ত্ববিদরা বলেন যে, আরব দেশ এককালে সাহারা মরুভূমির এক স্বাভাবিক সংযুক্ত অংশ ছিল; এক্ষণে লোহিত সাগর একে আলাদা করে রেখেছে। কেবল তাই নয়; যে বালুকাময় ভূখণ্ড মধ্য-ইরান ও গোবী মরুভূমির ভিতর দিয়ে এশিয়ার এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে, আরব দেশ তার সঙ্গেও যুক্ত ছিল। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ দেশসমূহের মধ্যে আরব অন্যতম। যদিও এর পূর্ব ও পশ্চিমে সমুদ্র বর্তমান, কিন্তু সে সমুদ্রের পরিসর অত্যন্ত অল্প। এশিয়া-আফ্রিকার বিরাট বৃষ্টিহীন ভূখন্দ্রে আবহাওয়ার সঙ্গে এর আবহাওয়া অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পৃক্ত। পূর্ব পশ্চিমের ক্ষুদ্র পরিসর সমুদ্রের পানি সে আবহাওয়াকে মোলায়েম করতে পারে না। দক্ষিণের সন্দ্র হতে কিছু বৃষ্টি আসে, সন্দেহ নাই; কিন্তু মৌসুমী হাওয়া মাঝে মাঝে দেশের উপর প্রবাহিত হলেও দেশের ভিতরের অংশের জন্য তার বুকে বিশেষ কোন বাষ্প অবশিষ্ট থাকে না। স্বাস্থ্যপ্রদ স্নিগ্ধ পুবালী বাতাস বরাবরই কেন আরব কবিগণের রচনার বিষয় হয়েছে, তা বোঝা কঠিন নয়।
বেদুঈন তার পিতৃ-পিতামহের মত এখনো ছাগল ও উটের পশমের তাঁবুতে বাস করে এবং সেই প্রাচীন চারণভূমিতে তার ভেড়া ও বকরী চরায়। ভেড়া, উট ও ঘোড়া পালন, শিকার ও লুণ্ঠন-এই হল বেদুঈনের নিয়মিত পেশা; আর তার বিবেচনায় মরদের পক্ষে এই-ই ইস্যুতের পেশা। তার দৃঢ় বিশ্বাস, কৃষি এবং সর্বপ্রকার শিল্প ও ব্যবসায় তার মর্যাদার অনুপযোগী। আসলে আবাদযোগ্য জমিনের পরিমাণও নগণ্য। সামান্য গমের আবাদ হয়। বেদুঈনের পক্ষে রুটি বিলাসের খাদ্য। সামান্য কিছু গাছপালা আছে খেজুর গাছ। আর আছে সেই গুল্ম যা থেকে দক্ষিণ-আরবের বিখ্যাত কফী তৈরি হয়। (১৪শ শতাব্দীর আগে, এর চল হয় নাই) মরূদ্যানে জন্মে নানা রকম ফল, বাদাম, আখ ও তরমুজ। দক্ষিণ-আরবের সেকালের বাণিজ্য-জীবনে গুগ্গুলের মস্ত গুরুত্ব ছিল। সে গুগুল আজো প্রচুর জন্মে।
আরব শুষ্ক নিষ্করুণ দেশ : বাতাস শুকনা, জমি লবণাক্ত। বারো মাস প্রবাহিত হয় এবং সমুদ্র গিয়ে পড়েছে, এমন একটি নদীও নাই। ছোট ছোট নদী যা আছে, তার একটি জাহাজ কিংবা নৌকা চালাচলের উপযোগৗ নয়। নদী নালার জায়গায় আছে অনেকগুলি ওয়াদী। কখনো বান প্লাবন এলো এই ওয়াদী পথে তো চলে যায়। এসব ওয়াদীতে আরো একটি কাজ হয় : হজযাত্রীদের এবং সাধারণ কাফেলার পথ নির্ণয় এরাই করে। ইসলামের অভ্যুদয়ের সময় হতে হজই আরবের সঙ্গে বাইরের জগতের যোগসূত্র স্থাপন করে এসেছে।