১৪৯৯ সালে রানী ইসাবেলার ধর্মগুরু কার্ডিনাল জিমেনেজ-ডি-সিসনারোর নেতৃত্বে জোর করে ধর্মান্তর কর গ্রহণের অভিযান শুরু হয়। কার্ডিনাল প্রথম চেষ্টা করেন ইসলাম বিষয়ক সমস্ত আরবী বই পুড়িয়ে ফেলতে। গ্রানাডার আরবী পাণ্ডুলিপি পোড়ানোর উৎসব শুরু হয়। এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিধর্মী উচ্ছেদ আদালত (ইনকুইজিশন)! এর কাজ জোরেশোরে চলতে থাকে। গ্রানাডার পতনের পর যেসব মুসলমান স্পেনে রয়ে যায়, তাদের সবাইকে এখন থেকে বলা হয়, ‘মরিসকো’ (স্পেনীয় ভাষায় এর মানে হোট মুর)। রোমকরা পশ্চিম-আফ্রিকাকে বলত, মরেটানিয়া আর বাসিন্দাদের বলত ‘ম-রী’ (মনে হয়, আসলে ফিনিশীয় শব্দ–মানে পাশ্চাত্য)। এই মরী হতে স্পেনীয় মোয়রা এবং ইংরেজি মুর শব্দের উৎপত্তি। বার্বাররাই প্রকৃত মুর ছিল। কিন্তু স্পেন ও উত্তর পশ্চিম আফ্রিকার সমস্ত মুসলমানকেই মুর বলা হয়। ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে পাঁচ লাখ মুসলমান আছে; এদের বলা হয়, মোরো। মেগেলান কর্তৃক ১৫২১ সালে এই দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কৃত হওয়ার পর স্পেনীয়রা তথাকার মুসলমানদের এ নাম দেয়।
মুসলিম স্পেনীয়রা একটি রোমান্স উপভাষায় কথা বলত। কিন্তু ব্যবহার করত আরবী হরফ। বেশীর ভাগের না হলেও অনেক মরিসকোরই পূর্বপুরুষ স্পেনীয় ছিল। কিন্তু এখন সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, তাদের পূর্বপুরুষরা খৃষ্টান ছিল; কাজেই তাদের হয় আবার খৃস্টান হতে হবে, নইলে তার ফল ভোগ করত হবে। মুদেজারদের মরিসকোদের সঙ্গে এক শ্রেণীভুক্ত করা হয়। এদের অনেকে প্রকাশ্যে খৃস্টান ধর্ম স্বীকার করত; কিন্তু গোপনে ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। কেউ কেউ খৃস্টানী মতে বিয়ে করে বাড়ী এসে গোপনে ইসলামী মতে ফের বিয়ে করত। অনেকে বাইরে খৃস্টানী নাম রাখত–আর বাড়ীতে ব্যবহারের জন্য আরবী নাম রাখত। ১৫০১ সালে কেস্টাইলে এক রাজকীয় আদেশে ঘোষণা করা হয় যে, কেস্টাইল আর লিয়নের সব মুসলমানকে হয় খৃস্টান হতে হবে, না হয় স্পেন ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে মনে হয়, এ ঘোষণা অনুযায়ী যথাযথ কাজ হয় নাই। ১৫২৬ সালে আরাগনের মুসলমানদের উপর ঐ একই আদেশ জারী হয়। ১৫৫৬ সালে দ্বিতীয় ফিলিপ এক আইন জারী করেন যে, বাকী মুসলমানদের অনতিবিলম্বে তাদের ভাষা, নামাজ-রোজা, অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং জীবনযাত্রা প্রণালী ত্যাগ করতে হবে। তিনি এমন আদেশ দিয়ে বসেন যে, স্পেনীয় গোসলখানাগুলিও বিধর্মীদের চিহ্ন; কাজেই সেগুলি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। গ্রানাডা-অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয় (এই দ্বিতীয় বার) এবং পার্শ্ববর্তী পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে। তবে সে বিদ্রোহ দমন করা হয়। ১৬০৯ সালে তৃতীয় ফিলিপ মুসলিম বিতাড়নের শেষ হুকুম-নামায় দস্তখত করেন। এর ফলে স্পেনের সমস্ত মুসলমানকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। কথিত আছে, প্রায় পাঁচ লক্ষ মুসলমান আফ্রিকা বা অন্য কোন মুসলিম দেশে যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠতে বাধ্য হয়। প্রধানতঃ এই মরিসকোদের মধ্য হতেই পরে পয়দা হয় মরক্কোর জল-দস্যুদল। হিসেবে দেখা যায় যে, গ্রানাডার পতন ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মুসলমান হয় নির্বাসিত, না হয় নিহত হয়। স্পেনের মুর-সমস্যার এইভাবে চিরসমাধান ঘটে। আরবী-সভ্যতা যেখানে একবার শিকড় গেড়েছে, সেখানেই চিরস্থায়ী হয়েছে–স্পেন এই সাধারণ নিয়মের স্পষ্ট ব্যতিক্রম। মুররা নির্বাসিত হল। খৃস্টান-স্পেনকে ধার-করা আলো নিয়ে কিছুকাল চাঁদের মত উজ্জ্বল প্রতীয়মান হল। তারপর নেমে এল অন্ধকার। সেই হতে স্পেন অন্ধকারে ঘুরে মরছে।’
স্পেনে ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপত্য-শিল্পের সমস্ত কীর্তি ধ্বংস পেয়েছে। একমাত্র টিকে আছে কর্ডোভার মহান মসজিদ। ৭৮৬ সালে একটি পুরোনো গীর্জার অবস্থান-ভূমিতে এ মসজিদের ভিত্তি স্থাপিত হয়। গীর্জায় আগে এখানে ছিল একটি রোমক মন্দির। চতুষ্কোণ মিনার সম্বলিত এর প্রধান অংশের কাজ ৭৯৩ সালে শেষ হয়। মিনারগুলি আফ্রিকার ভাস্কর্য-রীতি মোতাবেক নির্মিত হয়। আফ্রিকান রীতির মূল ছিল সিরীয়-রীতি। ১১৯টি স্তম্ভ এর ছাদ ধারণ করত। গীর্জার ঘন্টা দিয়ে নৈপতলের বাতি মসজিদের আলো দিত। একটি বাতি ঋড়ে এক হাজার আলো জ্বলত; সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র ঝড়েও জ্বলত বারোটি। সিরিয়ার উমাইয়া মসজিদ নির্মাণে যেমন বাইজেন্টাইন রাজমিস্ত্রী মোতায়েন করা হয়, এখানেও তেমনি তারা নিযুক্ত হয়। এর স্থাপয়িতা গথদের নিকট হতে লুষ্ঠিত ৮০ হাজার দিনার মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করেন। ১০০০ সাল পর্যন্ত মুসলমানেরা এর মেরামত ও সম্প্রসারণ করেন। আজ এ মসজিদ একটি গীর্জা।
ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য-নিরপেক্ষ স্থাপত্য-শিল্পের মধ্যে সেভিলের আলকাজার (আরবী শব্দ) এবং গ্রানাডার আলহামরার ধ্বংসাবশেষ অপূর্ব সুন্দর। এর কারু সজ্জা ছিল বহাল–কিন্তু বিচিত্র ও রমনীয়। সেভিলের আল-কাজারের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন অংশ টলেডোর একজন স্থপতি ১১৯৯-১২০০ সালে জনৈক আল মোয়াহেদী গভর্নরের জন্য তৈরী করেন।
মুসলিম স্পেনে আল-মোরাভাইডদের পর আল-মোয়াহেদীরা দ্বিতীয় বার্বার শাসক বংশ ছিল। আরবীতে একেশ্বরবাদী অর্থবোধক একটি শব্দ হতে এদের ঐ নাম হয় । নিষ্ঠুর রাজা পিটারের জন্য ১৩৫৩ সালে মুদেজার স্থপতিরা মুসলিম স্টাইলে আল-কাজার পুননির্মাণ করে। কিছুদিন আগেও এ ইমারত রাজপ্রাসাদরূপে ব্যবহৃত হত। কর্ডোভা, টলেডো ও অন্যান্য বহু স্পেনীয় শহরে আল-কাজার ছিল; তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ছিল সেভিলের আল-কাজার এবং একমাত্র এই প্রাসাদটিই এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে। টলেডোর আল কাজারটি শেষ গৃহযুদ্ধে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।