অর্থনৈতিক অবস্থাও সাম্রাজ্য-রক্ষার পক্ষে প্রতিকূল ছিল। কর বসানো ও আঞ্চলিক শাসন শাসক-শ্রেণীর স্বার্থে পরিচালিত হওয়ায় কৃষি ও শিল্প পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে না। শাসকরা যে পরিমাণে ধনী হয়ে ওঠে, জনসাধারণ সেই পরিমাণেই গরীব হয়ে পড়ে। জমিদারীর অধীনে উপ-জমিদারীর সৃষ্টি হয় এবং শেষোক্ত প্রথার মালিকরা প্রজা-সাধারণকে লুট করে খেত। ঘন ঘন রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের ফলে লোক-সংখ্যা কমে যায় এবং অনেক ক্ষেত-খামার অনাবাদী পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে মেসোপটেমিয়ার নিম্ন অঞ্চলে বন্যা ধ্বংসের তা শুরু করতঃ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ দুর্ভিক্ষ, বহু এলাকা প্লেগ, বসন্ত, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি ব্যারামের মড়কে উজাড়-প্রায় হয়ে যেত। আরব ইতিহাসে বিজয়ের প্রথম চার শতাব্দীতে চল্লিশটি ব্যাপক মড়কের বিবরণ পাওয়া যায়। যে সব কারণে প্রাচ্যে এবং সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে মুসলিম-শক্তি ভেঙ্গে পড়ে, মোটামুটি ড্রপ কারণেই স্পেন ও ইউরোপের অন্যান্য অংশে মুসলিম-শক্তির পতন ঘটে। তফাতের মধ্যে এই ছিল যে, এখানে মঙ্গোলদের বদলে খৃষ্টানরা মৃত্যুবাণ হানে।
১০৩১ সালে কর্ডোভার উমাইয়া খিলাফতের পতন হয়। এর ধ্বংসস্তূপ হতে ছোট ঘোট এক ঝাঁক রাজ্যের উদ্ভব হয়। এসব রাজ্য ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি কাটাকাটি করে নিজেদের শক্তি-ক্ষয় করে। বিশটি শহর ও অঞ্চলে এমন বিশটি রাজ্যের উত্থান হয়। গ্রানাডার পরই সেভিলের ছিল গৌরবময় স্থান। কিন্তু শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই সেভিল এক নতুন উদীয়মান শক্তির হাতে পড়ে। এ শক্তি ছিল, মরক্কো হতে আগত এক বার্বার বংশ। এমনিভাবে স্পেনে বাবার প্রভুত্বের সূচনা হয়।
এ বার্বার বংশের নাম ছিল আল-মোরাভাইড। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা ও স্পেন উভয়ই এদের আয়ত্তে ছিল। বংশের নামটি ছিল এক আরবী শব্দের অপভ্রংশ–মানে যোদ্ধা-দরবেশ দল। এরা প্রথমে এক সামরিক ভ্রাতৃসংঘ ছিল এবং সে সব কওমের পুরুষেরা চোখের নীচে মুখমণ্ডলের বাকী অংশ পরদায় ঢেকে রাখতো, এরা তাদের মধ্য হতে লোক সংগ্রহ করত। তাদের বংশধর ‘তুয়ারেগ’ কওম এখনো অমন পরদা পরে। এই জন্য এদের অন্য নাম হয় ‘পরদা পরনেওয়ালা’। আল-মোরাভাইডদের পর আরো একটি বার্বার বংশের অভ্যুদয় হয়। আরব বংশসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, গ্রানাডার নাসরিদ বংশ। এই বংশেরই মুহম্মদ আল-গালিব বিশ্ববিখ্যাত আলহামরা নির্মাণ করেন।
মুসলিম-শক্তির পতনকালে প্রাচ্য বা পাশ্চত্য জগতে যে সব ছোট ছোট রাজ্যের উত্থান-পতন হয়, তাদের ইতিহাস নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই না। তবে সে কাহিনীর একটা মোটামুটি ধারণা আমাদের থাকা দরকার। বিশেষ করে ইউরোপে মুসলিম-শক্তির শেষ দিকের ঘটনাবলী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, যখন তারা পরস্পরকে ধ্বংস করতে ভীষণভাবে লিপ্ত, তখন তারা তাদের সংস্কৃতির বিস্তার-সাধনের কথা ভোলে নাই। কোন মানুষের পক্ষে তার জ্ঞান ও শিল্পকে অপরের মধ্যে প্রসারিত করার যে শক্তি, তা-ই তার সভ্যতার গৌরব ও বেঁচে থাকার ক্ষমতার পরিচায়ক।
একাদশ শতাব্দীতে যখন উমাইয়া খেলাফতের পতন হয়, তখনই খৃস্টান শক্তি কর্তৃক স্পেনের পুনর্জয়ের যুগ শুরু হয়। ৭১৮ সালে কোভাডোঙ্গার লড়াইয়ে অসুরিয়ান নেতা পিলায়ে মুসলিম অগ্রগমন রোধ করেন। স্পেনীয় ঐতিহাসিকেরা এই যুদ্ধ-জয়কেই স্পেন পুনর্জয়ের আরম্ভ মনে করে থাকেন। যদি মুসলমানরা অষ্টম শতাব্দীতে পর্বতাকীর্ণ উত্তর অঞ্চলের খৃস্টান-শক্তির শেষ দীপ নিভিয়ে দিত, তবে স্পেনের পরবর্তী ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদাভাবে লিখিত হতে পারত। উত্তরের খৃস্টান দলপতিদের মধ্যে প্রথম ভয়ঙ্কর আত্মকলহ থাকায় পুনর্জয়ের কাজে বাধা সৃষ্টি হতে থাকে; কিন্তু ১২৩০ খৃস্টাব্দে কেস্টাইল ও লিয়ন সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে মুসলিম শক্তির পতন দ্রুত গতিতে চলে। এয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত গ্রানাডা ছাড়া পুনর্জয় কার্যতঃ শেষ হয়ে যায়। ১০৮৫ সালে টলেডোর, ১২৩৬ সালে কর্ডোভার এবং ১২৪৮ সালে সেভিলের পতন হয়।
এয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পর দুটি বড় কাজ শুরু হয় : স্পেনকে খৃস্টানীকরণ ও তার ঐক্য বিধান। এককালে, স্পেনের যে অংশে সেমিটিক ও কার্থেজেনীয় সভ্যতার বিকাশ লাভ ঘটেছিল, কেবল সেই অংশে ইসলাম শিকড় গাড়ে। সিসিলীতেও ঐ ব্যাপারই ঘটে। এ ব্যাপারটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাচীনকালে পিউনিক ও পাশ্চাত্য-সভ্যতার মধ্যে যে পর্যায়ের বিভেদ ছিল, ইসলাম ও খৃষ্টান ধর্মের মধ্যের বিভেদ মোটামুটি সেই পর্যায়ে বরাবরই বিদ্যমান ছিল। ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বহু মুসলমান বিজিত হয়ে বা সন্ধি-সূত্রে খৃষ্টান শাসনাধীনে চলে যায়; কিন্তু তারা অন্যান্য ব্যাপারে তাদের আইন ও ধর্ম রক্ষা করে চলতে থাকে। এইসব মুসলমানকে বলা হত মুদেজার।’ ‘পোষ মানা’ অর্থবোধক একটি আরবী শব্দ হতে এই শব্দটি উদ্ভূত। বহু মুদেজার এই সময় আরবী ভুলে গিয়ে কেবল রোমান্স ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে এবং খৃস্টানদের সঙ্গে অনেকটা এক হয়ে যায়।
স্পেনে অবশেষে ঐক্য-সাধনার কাজ ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে চলতে থাকে। এই সময় খৃস্টান আধিপত্য কেস্টাইল ও আরাগন রাজ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৪৬৯ খৃস্টাব্দে আরাগনের ফার্ডিন্যান্ড ও কেস্টাইলের ইসাবেলার মধ্যে বিয়ে হয় এবং উভয় রাজ্য চিরতরে এক হয়ে যায়। এই মিলন মুসলিম-স্পেনের ধ্বংসের পথ অবারিত করে দেয়। এই ক্রমবর্ধমান বিপদের সম্মুখীন হওয়া নাসরিদ বংশের সাধ্যাতীত ছিল। এ বংশের শেষ সুলতান এক রক্তক্ষয়ী আত্মকলহে লিপ্ত হন এবং তার অবস্থা আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। ১২৩২ হতে ১৪৯২ পর্যন্ত যে একুশজন সুলতান রাজত্ব করেন, তাঁদের মধ্যে ছয়জন দুইবার এবং একজন তিনবার রাজত্ব করেন। যে সময় আমেরিকার ইতিহাসের সূচনা, ঠিক সেই ১৪৯২ সালে এক দীর্ঘ অবরোধের পর খৃস্টান সৈন্যদের হাতে গ্রানাডার পতন ঘটে–স হেলালকে উৎখাত করে। উদার ম্রাট ও ম্রাজ্ঞী ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা আত্মসমর্পণের শর্ত পালন করলেন না।