এয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত আরব-বিজ্ঞান ও দর্শনের ইউরোপ গমন সমাপ্ত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই স্রোত টলেডো হতে পিরেনীজ পর্বতের আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে প্রোভেন্স এবং আল্পসের গিরি-পথে লোরেইন, জার্মানী এবং মধ্য-ইউরোপে গিয়ে পৌঁছে এবং সেখান হতে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে হাজির হয়। ফ্রান্সে মার্সাই, তুলো, নারবেন এবং মন্টপেলিয়ার আরব চিন্তার কেন্দ্রস্থল ছিল। পূর্ব ফ্রান্সের অন্তর্গত কুনিতে একটি বিখ্যাত মঠ ছিল; এই মঠে কয়েকজন স্পেনীয় পাদ্রী ছিলেন। ফলে দ্বাদশ শতাব্দীতে এই স্থান আরব-জ্ঞান প্রচারের একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানকার পিটার ভেনারেবল নামক মঠাধ্যক্ষ ১১৪১ সালে অন্যান্য বহু পুস্তিকা ছাড়া কোরানের প্রথম ল্যাটিন অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। অবশ্য এসব ইসলামের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। দশম শতাব্দীতে লোরেইন বা লোথারিনজীয়াতে আরবী-বিজ্ঞান প্রবেশ লাভ করে। তার ফলে পরবর্তী দুই শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান বৈজ্ঞানিক প্রভাবের কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হয়। লোথারিনজীয়ার শহরগুলির মধ্যে লীজ, গোরজ এবং কোলন আরবী জ্ঞানের অঙ্কুর উদগমের জন্য একান্ত উর্বর-ভূমি ছিল। লোরেইন হতে এ জ্ঞানের আলোক জার্মানীর চারদিকে বিচ্ছুরিত হয় এবং লোরেইনবাসী বা লোরেইনে শিক্ষাপ্রাপ্ত লোক দ্বারা নর্মান যুগের ইংল্যান্ডে নীত হয়।
এভাবে স্পেনীয় আরব জ্ঞান-বিজ্ঞান সমস্ত পশ্চিম-ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে । আর এর মাধ্যম হিসেবে স্পেনের ব্রতও সাধিত হয়।
১৬. ক্রুস হেলালকে উৎখাত করে
যে অত্যদ্ভূত দ্রুতগতিতে আরবের মরু সন্তানেরা হিজরী প্রথম শতাব্দীর মধ্যে তৎকালীন সভ্য-জগতের অধিকাংশ জয় করে ফেলে, তার সঙ্গে সঙ্গে তুলনীয় যদি কিছু থাকে, তবে তা হযরত মুহম্মদের (সঃ) মৃত্যুর পর তৃতীয় শতকের মধ্য হতে চতুর্থ শতকের মধ্য পর্যন্ত কালের ভিতর আরব-আধিপত্যের দ্রুত অধঃতন। ৮২০ খৃস্টাব্দের কাছাকাছি সময় বাগদাদের খলীফার একক হাতে যে প্রভুত্ব-ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল, তা অন্য কোন জীবিত লোকের হাতে ছিল না। ৯২০ খৃস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সেই ক্ষমতা তার পরবর্তীদের হাতে এত খর্ব হয়ে পড়ে যে, তার নিজ রাজধানীতেও সে ক্ষমতা বিশেষ অনুভূত হত না। ১২৫৮ সালে বাগদাদ শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ শহরের সঙ্গে আবার প্রভুত্বও চিরবিদায় গ্রহণ করে এবং সত্যিকার খিলাফতের ইতিহাস খতম হয়ে যায়।
বাইরের কারণের মধ্যে মঙ্গোল বা তাফ্তারদের মত বর্বর জাতিসমূহের আক্ৰমণ জাকজমকপূর্ণ হলেও আসলে তা ছিল আরবজাতির শেষ পতনের অন্যতম কারণ। খিলাফতের কেন্দ্রভূমি ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানে যে অসংখ্য বংশ ও উপবংশের উত্থান হয়, তাতে রোগের লক্ষণই প্রকাশ পায়; ও গুলিকে রোগের কারণ বলা চলে না। পাশ্চাত্যের রোমক সাম্রাজ্যের মত, রুগ্ন মানুষটি ইতিপূর্বেই তার শেষ শয্যায় শায়িত ছিল–এমন সময় চোর এসে দুয়ার ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে এবং তার রাজকীয় উত্তরাধিকারের ভাগ কেড়ে নিয়ে সরে পড়ে।
খিলাফত খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। প্রথম যুগের অনেকগুলি বিজয় কেবল নামে বিজয় ছিল। তাছাড়া, শাসন-পদ্ধতি স্থায়িত্বের অনুকূলে ছিল না। প্রায় সর্বত্রই শোষণ ও অতিরিক্ত কর-ভারে প্রজাপুঞ্জ পীড়িত ছিল। আরব অনারব, আরব-মুসলমান, অনারব-মুসলমান, মুসলমান-জিম্মী–এদের মধ্যে বিভেদ রেখা অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। স্বয়ং আরবদের মধ্যেই উত্তর-আরব আর দক্ষিণ-আরবের মধ্যকার প্রাচীন রেষারেষি তেমনি তীব্রভাবে বিদ্যমান ছিল। ইরানের পারসিকতরা, তুবাণের তুর্করা আর হেমিটিক বার্বাররা সেমিটিক আরবদের সঙ্গে কখনো এক অভিন্ন জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। কোনো আত্মবোধই এই বিভিন্ন জন-সংঘকে একত্রে বেঁধে রাখতে পারে নাই। ইরানের সন্তানেরা কখনো তাদের জাতির অতীত গৌরব-মহিমা ভুলতে পারে নাই এবং কখনো এ নতুন শাসন-ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ আপনভাবে গ্রহণ করে নাই। সিরিয়ার লোকেরা বহুকাল পর্যন্ত আশান্বিত চোখে চেয়ে ছিল যে, তাদের কোন নেতা আবির্ভূত হয়ে আব্বাসীয়দের অধীনতার বন্ধন হতে তাদের মুক্ত করবে। বার্বাররা সুযোগ মিললে যে কোন ষড়যন্ত্রে যোগ দিত এবং অস্পষ্টভাবে হলেও এর থেকে বুঝতে বাকী থাকত না যে, তারা তাদের কওমী দৃষ্টিভঙ্গী বা আরবদের সঙ্গে তাদের বিভিন্নতা কিছুতেই ভোলে নাই। রাজনীতি ও সমর ক্ষেত্রে যেমন–ধর্মেও তেমনি বিভেদ রেখা ফুটে ওঠে এবং তার ফলে অদ্ভূত হয় শীয়া, কারমাতী, ইসমাইলী, খারেজী ইত্যাদি মাযহাব। এইসব সম্প্রদায়ের কতকগুলি ধর্মীয় দল ছাড়া আরো কিছু ছিল। সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্ত কতকগুলো ধর্মীয় দল ছাড়া আরো কিছু ছিল। সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্ত কারমাতীদের আঘাতে টলে ওঠে; ফাতেমীরা অনতিকাল মধ্যে পশ্চিম ভাগ অধিকার করে নেয়। খিলাফত যেমন ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহের সঙ্গে মধ্য-এশিয়ার দেশসমূহকে মিলিয়ে এক স্থায়ী অখণ্ডরাজ্য গড়ে তুলতে পারে নাই, ইসলামও তেমনি তার বিভিন্ন অনুবর্তীদের এক অখণ্ডজাতির বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারল না।
এরপর সামাজিক ও নৈতিক প্রভাবও সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের অনুকূল ছিল । কয়েক শতাব্দীর মধ্যে বিজেতা জাতিসমূহের রক্ত বিজিতদের রক্তের সঙ্গে মিশে পাতলা হয়ে পড়ে; ফলে বিজেতারা তাদের বিশিষ্ট গুণ ও আধিপত্যের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আরব জাতীয়-জীবনের পতনের সঙ্গে আরবদের সহন-শক্তি ও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। ক্রমে ক্রমে সাম্রাজ্য বিজিতদের সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। শাহীমঞ্জিলে হেরেম ও তার সংশ্লিষ্ট অসংখ্য খোঁজা, বালক-বালিকা গোলাম বাঁদী, গিলমান (এসব নারী-পুরুষ উভয়কে পতনের শেষ পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছায়), অগণ্য উপপত্নী ও সতেলা ভাইবোন, তাদের হিংসা ও ষড়যন্ত্র, মদ ও সঙ্গীত প্রধান বিলাসময় জীবন–এই সমস্ত এবং অনুরূপ অন্যান্য শক্তি মিলে পারিবারিক জীবনের প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে ফেলে। সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অন্তহীন কলহ দুর্বল উত্তরাধিকারীদের অবস্থা আরো অনিশ্চিত করে তোলে।