সুবিখ্যাত মনীষী চিন্তানায়ক ইবনে রুশদ ১১২৬ সালে কর্ডোভা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রহ-বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং আরাস্তুর ভাষ্যকার ছিলেন। পাশ্চাত্য-জগতের উপর তিনি যে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেন, সে হিসেবে তাকে মুসলিম জগতের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক বলতে হয়। ইবনে রুশদের বড় অবদান একটি চিকিৎসা-পুস্তক। এতে তিনি বলেন যে, বসন্ত একজনকে একাধিকবার আক্রমণ করে না। তিনি রেটীনার কাজ নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেন। ইহুদী ও খৃস্টান জগতে কিন্তু তিনি প্রধানতঃ আরাস্তুর ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মধ্যযুগের ভাষ্যকার মানে ছিল, সেই ব্যক্তি যিনি পূর্ববর্তী চিন্তাবিদের লেখাকে পটভূমি করে কোন বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক বই লিখতেন। এই নিয়ম অনুসারে ইবনে রুশদ এক সিরিজ বই লেখেন এবং তাতে তিনি আংশিকভাবে আরাস্তুর বইয়ের নাম ব্যবহার করেন এবং তাঁর লেখার ব্যাখ্যা করেন। তিনি এশিয়া বা আফ্রিকার ছিলেন যতখানি, তার চেয়ে বেশি ছিলেন ইউরোপের। পাশ্চাত্য-জগতের চোখে আরাস্তু যেমন ছিলেন ‘প্রকৃত শিক্ষক, ইবনে রুশদ তেমনি ছিলেন প্রকৃত ভাষ্যকার।’ মধ্যযুগীয় ইউরোপের খৃস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ ও পণ্ডিতদের মনে ইবনে রুশদ যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন, এমন আর কোন গ্রন্থকারই করতে পারেন নাই। ইবনে রুশদের বই প্রথমে স্পেনের গোঁড়া মুসলমানদের মনে, পরে তালমুদীদের মনে এবং সর্বশেষে খৃস্টান পাদ্রী-পুরোহিতদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে মোড়শ শতাব্দীর অবসান কাল পর্যন্ত চিন্তা-জগতে ইবনে রুশদের মতবাদই প্রবল থাকে। ইবনে রুশদ যুক্তিবাদী ছিলেন এবং ধর্মের প্রত্যাদিষ্ট আদেশ-নিষেধ ছাড়া সব বস্তুরই স্বাধীনভাবে যুক্তির সাহায্যে বিচারের অধিকার দাবী করতেন। কিন্তু অনেকে যে মনে করে তিনি স্বাধীন চিন্তা ও কুফরের জনক এবং ধর্মের শত্রু ছিলেন, তা মোটেই সত্য নয়। প্রাথমিক মুসলিম আরাস্তুবাদীরা নিও-প্যাটোনিক ধরনের কতকগুলি বই সহ অনেকগুলি প্রক্ষেপ-দুষ্ট বইকে নিভাজ বলে মনে করেন। ইবনে রুশদের দর্শন সে সব বর্জন করে অকৃত্রিম ও বিজ্ঞানসম্মত আরাস্তুবাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। পাদ্রীদের দ্বারা আপত্তিকর অংশ বাদ দেওয়ার পর তাঁর লেখা প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইরূপে, নির্বাচিত হয়। এ লেখার যত নিন্দা ও ভুল ব্যাখ্যাই থাক, তবু আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের অভুদয়ের আগ পর্যন্ত ইবনে রুশদের প্রবর্তিত চিন্তাধারাই ইউরোপীয় চিন্তা-জগতে জীবন্ত শক্তিরূপে ক্রিয়া করতে থাকে।
ইবনে রুশদের পর এ যুগের দার্শনিকদের মধ্যে প্রথম স্থানের দাবীদার হচ্ছেন, তাঁর সমসাময়িক কর্ডোভার মনীষী ইবনে মায়মুন। ইনি মোশেহ মায়মুন। বা মায়মুনাইডিস বলেও বিখ্যাত। সমস্ত আরবীয় অগ্রগতির যুগের মধ্যে ইনিই সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ইহুদী চিকিৎসক ও দার্শনিক ছিলেন। ১১৩৫ সালে ইনি কর্ডোভায় জন্মগ্রহণ করেন; তাঁর পরিবার ১১৬৫ সালে কায়রোতে চলে যায়। কেউ কেউ বলেন যে, স্পেনে ইবনে মায়মুন প্রকাশ্যে নিজকে মুসলমান বলে পরিচয় দিতেন; কিন্তু নিজ গৃহে গোপনে ইহুদী ধর্ম পালন করতেন। ইদানীং গবেষকরা সকলে এ মত সমর্থন করতে পারেন নাই। কায়রোতে তিনি বিশ্ববিশ্রুত সালাহউদ্দীন ও তার পুত্রের সরকারী চিকিৎসক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সাল হতে তিনি কায়রোর ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মযাজক ছিলেন। এইখানে ১২০৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর ওসিয়ৎ মোতাবেক যে পথে একদা হযরত মুসা চলেছিলেন, সেই পথে তার লাশ হাতে বহন করে টাইবেরিয়াসে সমাহিত করা হয়। আজো সেখানে তার অনাড়ম্বর সমাধির পাশে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী সমবেত হয়ে থাকে। কায়রোতে রাব্বী মোশে-বেন-মায়মুনের যে গীর্জা (সিনাগগ আছে, আর সংলগ্ন ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে দূর দূরান্তর হতে দরিদ্র ইহুদী বিমারীরা এসে ভিড় করে এবং তথায় রাত্রি যাপন করে রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে। ইহুদী সমাজে যে তিনি কত বড় শ্রদ্ধার আসন অধিকার করে আসছেন, তা সে সমাজে প্রচলিত এই প্রবাদ বাক্যটিতেই বোঝা যায় : মুসা হতে মুসা পর্যন্ত মুসার মত কেউ ছিল না?
ইবনে মায়মুন গ্রহ-বিজ্ঞানী, ধর্ম-বিজ্ঞানী, চিকিত্সক এবং সর্বোপরি দার্শনিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ত্বক-ছেদন পদ্ধতির উন্নতি বিধান করেন, কোষ্ঠ কাঠিন্যকে হেমোরাইডস ব্যারামের কারণ বলে রায় দেন এবং স্বাস্থ্য বিজ্ঞান সম্বন্ধে উন্নত ধারণা পোষণ করতেন। তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থের নাম ‘দালালাতুল হায়রিন’ (বিভ্রান্তদের পথপ্রদর্শক)। এ পুস্তকে তিনি ইহুদী ধর্ম শাস্ত্রের সঙ্গে মুসলিম আরাস্তুবাদ অথবা ব্যাপক অর্থে বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তি সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। এইদিক হতে অন্ততঃ তিনি বাইবেলের স্বতঃসিদ্ধবাদের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাহসী সমর্থক ছিলেন। ফলে তিনি গোঁড়া শাস্ত্রবিদদের রোষ-ভাজন হন। এরা তার বইয়ের নাম দেয়, দালালাহ’ (গোমরাহকরণ)। স্বাধীনভাবে গবেষণা করলেও তাঁর দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে ইবনে রুশদের মতবাদের সাদৃশ্য দেখা যায়। ইবনে রুশদের মত তিনিও গ্রীক ভাষায় অজ্ঞ ছিলেন এবং সম্পূর্ণভাবে আরবী অনুবাদের উপর নির্ভর করতেন। সৃষ্টি সম্বন্ধে তিনি অনু-মতবাদ (আল্লাহ সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা) আর নিও প্ল্যাটোনিক ও আরাস্তুর দার্শনিক মতবাদ। একটি ছাড়া ইবনে মায়মুনের সব বই আরবী ভাষায় লিখিত হয় এবং শীঘ্রই সে সব বই হিব্রুতে ও পরে আংশিকভাবে ল্যাটিনে অনূদিত হয়। তাঁর মতবাদের ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ইহুদী ও খৃস্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তাঁর গ্রন্থাবলীই ইন্দী চিন্তাকে জেনটাইলদের নিকট পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম ছিল। আধুনিক সমালোচকেরা তার প্রভাবের পরিচয় বহু জনের মধ্যে দেখতে পান : যেমন–ডমিনিকান, ডান স্কোটাস, শিনোজা, এমন কি ক্যান্ট। এ যুগের মরমীবাদীদের মধ্যে ইবনে আরাবী প্রধান ছিলেন। সমগ্র ইসলামী সুফী-জগতে ইনি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাশালী চিন্তাবিদ ছিলেন। ইবনে আরবী সেভিলে জন্মগ্রহণ করেন। ১২৪০ সালে দামেস্কে তাঁর মৃত্যু হয়। আজো তাঁর মাজার তথায় বিদ্যমান। তার একখানা বইয়ে তিনি হযরত মুহম্মদের (সঃ) নৈশ ভ্রমণ ও আসমানে যাওয়ার কাহিনী নিয়ে আলোচনা করেন। এতে দান্তের মহাকাব্যের পূর্বাভাব মিলে।