গ্রহ-বিজ্ঞান ও গণিতের মত উদ্ভিদ-বিজ্ঞানেও পাশ্চাত্য মুসলিমরা তাঁদের গবেষণা দ্বারা পৃথিবীর জ্ঞান-ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁরা খেজুর গাছ ও শন প্রভৃতি বৃক্ষ-লতার যৌন-পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করেন। বৃক্ষ-লতাকে তারা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেন : যথা–যে সব উদ্ভিদ কলম হতে জন্মে, যে সব বীজ হতে জন্মে আর যে সব (তাদের বিবেচনায়) আপনা-আপনি জন্মে। সেভিলের ইবনুল আওয়াম দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কৃষি সম্বন্ধে একখানি বই লেখেন। এই বইখানি সমগ্র মুসলিম-জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম তো ছিলই, উক্ত বিষয়ে মধ্যযুগীয় শ্রেষ্ঠতম বইসমূহেরও অন্যতম ছিল। কতকটা পূর্ববর্তী গ্রীক ও আরব গবেষণা ও কতকটা স্পেনের মুসলিম কৃষকদের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে এ বইয়ে ৫৮৫টি উদ্ভিদ এবং পঞ্চাশটির অধিক ফল গাছ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়। গাছে কলম করা, বিভিন্ন রকম জমি ও সারের গুণাগুণ, আঙ্গুর ও অন্যান্য গাছের ব্যারামের লক্ষণ এবং সে ব্যারামের সহজ প্রতিকার ইত্যাদির উপর নতুন আলোকপাত করা হয়।
ইবনুল বায়তার স্পেনের হয়তো সমগ্র মুসলিম-জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ ও ঔষধ-মিশ্রণ বিজ্ঞানী ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তার লিখিত সহজ প্রতিকার’ মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ছিল।
স্পেনীয় আরব চিকিৎসকদের বেশীর ভাগেরই চিকিৎসা ছিল একটা অতিরিক্ত পেশা। আসল পেশা ছিল অন্যকিছু। ইবনুল খতীব আরো অনেক চিকিৎসকের মত উজীরের পদে সমাসীন ছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কালো মৃত্যু’ ইউরোপকে উৎসন্ন করতে থাকে। খৃষ্টান চিকিত্সকরা এ ব্যারামকে আল্লাহর গজব মনে করে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তখন গ্রানাডার এই মুসলিম চিকিৎসক সংক্রমণবাদের বাস্তব দিক বিশ্লেষণ করে একখানি বই লিখেন। বইখানিতে একটি সত্যিকার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়, যথা : ‘কেউ কেউ বলেন, সংক্রমণবাদকে কি করে স্বীকার করতে পারি?’ তাঁদের আমরা বলি : অভিজ্ঞতা, অনুসন্ধান, ইন্দ্রিয়ের সাক্ষ্য এবং নির্ভরযোগ্য দলীল সমস্তই সংক্রমণের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। কাজেই আমাদের যুক্তি নির্ভুল। যখন কেউ নিজ চোখে দেখে যে, ব্যারামীর কাছে গেলেই ব্যারাম হয়, আর দূরে থাকলেই ব্যারাম হয় না এবং কাপড়-চোপড়, বাসন-কোসন ও কানের গয়না মারফত কি রকমে ব্যারাম ছড়িয়ে পড়ে, তখন আর সংক্রমণের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তার কোন সন্দেহ থাকে না।
স্পেনে মুসলিম-আধিপত্যের প্রথম কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচ্য সংস্কৃতি উন্নততর স্তর হতে আন্দালুসীয়াতে প্রবাহিত হতে থাকে। স্পেনের জ্ঞানীরা বিদ্যার অন্বেষণে মিসর, সিরিয়া, ইরাক, পারস্য এবং ট্রান্স অকসিয়ানা ও চীন পর্যন্ত চলে যেতেন। কিন্তু একাদশ শতাব্দী হতে শুরু করে পরবর্তী শতাব্দীসমূহে স্রোতের গতি ফিরে যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে এই স্রোত এত কেঁপে ওঠে যে, তা ইউরোপেও গড়িয়ে পড়ে। আরব চিকিৎসা-বিজ্ঞান ইউরোপে প্রচার করার কাজে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা এবং স্পেন–বিশেষ করে টলেডো উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করে। এই টলেডোতেই ক্রেমোনার জিয়ার্ড এবং মাইকেল স্কট কাজ করতেন। এইভাবে মুসলিম, খৃস্টান ও ইহুদী চিকিৎসাশাস্ত্রের পরস্পর সাক্ষাৎ ঘটে এবং ভবিষ্যৎ মিলনের পথ প্রশস্ত হয়। এই উপায়ে এবং কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ। মারফত কতকগুলি আরবী পরিভাষা ইউরোপীয় ভাষায় প্রবেশ করে। যথা : জ্বলেপ’–(আরবী জুলাব), ফারসী গুলাব–গোলাব পানি) ঔষধ মিশ্রিত সুগন্ধ পানীয়; সীরাপ’ (আরবী শরাব) সরকারী ফরমূলা মোতাবেক তৈরী চিনির শরবত অনেক সময় ঔষধ মিশ্রিত। সোডা’–মধ্যযুগীয় ল্যাটিনে এর মানে ছিল মাথাধরা; আর সোডানাম’-এর মানে ছিল মাথা-ধরার ঔষধ। আসলে এ শব্দের মূল আরবী হচ্ছে, সুদা’–মাথার তীব্র বেদনা। আরবী হতে যেসব রাসায়নিক শব্দ ল্যাটিন মারফত ইউরোপীয় ভাষায় চলে গেছে, তার মধ্যে ‘অ্যালকোহল’, এলেমবিক’, ‘অ্যালকালী’ এবং অ্যানটিমনী’ উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেই স্পেনীয় আরবরা মহত্তম কীর্তি অর্জন করে। গ্রীক-দর্শনকে স্পেনীয় ও প্রাচ্য দেশীয় মুসলিম মনীষীদের হাতে প্রয়োজন মোতাবেক–বিশেষ করে বিশ্বাসও যুক্তি ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ব্যাপারে রূপান্তরিত করা হয় এবং সেই রূপান্তরিত জ্ঞান পাশ্চাত্যে প্রেরিত হয়। যে দর্শন গ্রীক মনীষীর সাধনায় এবং যে একেশ্বরবাদ-মূলক তত্ত্ব হিব্রু পয়গম্বরদের সাধনার বিকাশ লাভ করে, দুনিয়ার প্রতি প্রাচীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেই ছিল শ্রেষ্ঠতম অবদান।
পশ্চিম ইউরোপে এইরূপে যে নতুন ভাবধারা প্রথম প্রবেশ করে, তা প্রধানতঃ ছিল দর্শন ও চিকিত্সা ঘটিত এবং এই ভাবধারাই ‘অন্ধকার যুগের অবসান এবং তত্ত্ব-সাধকদের যুগের আগমন সূচনা করে। ইউরোপীয় পণ্ডিত ও দার্শনিকরা আরবদের সংস্পর্শে উজ্জীবিত হয়ে এবং গ্রীক জ্ঞানের নব পরিচয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে অল্পকাল মধ্যে নিজেরা স্বাধীনভাবে জ্ঞান-সাধনা শুরু করেন। আজো আমরা তারই ফল ভোগ করছি।
আমরা এখানে মুসলিম স্পেনের কৃতী দার্শনিকদের মাত্র কয়েক জনের নাম করতে পারি। এদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন ইবনে তোফায়েল (মৃত্যু ১১৮৫)। হায়য়ী-ইবনে-ইয়াজান’ (জাগ্রত জনের পুত্র জীবন্ত ব্যক্তি) নামক দার্শনিক উপখ্যান তার শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। এ গ্রন্থের মূলকথা এই যে, মানুষের ধারণা শক্তি বাইরের কোন সহায়কের আনুকৌল্য ছাড়াও উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং সে যে সর্বশক্তিমানের উপর নির্ভরশীল, ক্রমে ক্রমে তাও সে আবিষ্কার করতে পারে। কাহিনীটি মধ্যযুগীয় সাহিত্যে একটি মনোরম এবং মৌলিক অবদান। কেউ কেউ মনে করেন যে, রবিনসন ক্রুসোর মূল উৎস এই গ্রন্থ। বইটি ১৬৭১ খৃস্টাব্দে ছোট (ইয়াঙ্গার) এডওয়ার্ড পোক’ক কর্তৃক ল্যাটিনে অনূদিত হয়। এরপর ইউরোপের অন্যান্য বহু ভাষায় এর অনুবাদ হয়; যথা–১৬৭২ খৃস্টাব্দে ডাচ ভাষায়, ১৯২০ খৃস্টাব্দে রুশ ভাষায় এবং ১৯৩৪ খৃস্টাব্দে স্পেনীয় ভাষায়।