মুসলমানদের অভ্যুত্থান ও অভূতপূর্ব অগ্রগমন পৃথিবীর ইতিহাসে একটা বিপ্লব–একটা বিস্ময়। কেবল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সামরিক শৌর্য ও নৈপুণ্যের ক্ষেত্রেই নয়–জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও তাদের দান অতুলনীয়। আমাদের এই গরীয়ান পূর্বপুরুষদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এ সম্পর্কীয় অধিকাংশ বই-ই আরবী-ফার্সী ভাষায় লিখিত। এ বিষয়ে আমাদের মাতৃভাষায় রচিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা অতিনগণ্য। আজ আমাদের জাতীয় ক্রমবিকাশের তাগিদে এ সম্পর্কে অধিক সংখ্যক নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ বইয়ের প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে। মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গৌরবদীপ্ত আমাদের জাতির এই ইতিহাসের সাথে নিবিড় সংযোগ ও পরিচয় ঘটলে নিশ্চিতভাবে আমরা নব প্রেরণা লাভ করবো এবং এর ফলে আমাদের অগ্রগতিও অনেকখানি তুরান্বিত হবে।
এ দিক দিয়ে ঢাকার ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশান্সের উদ্যম নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাঁদের প্রচেষ্টায় খ্যাতনামা ইতিহাসবেত্তা ফিলিপ কে. হিষ্টির প্রখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ “দি হিস্ট্রি অব এ্যারাস’-এর বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। আরব জাতির আবদান সম্পর্কে গবেষণামূলক তথ্য-চিত্র এবং তাদের জীবনালেখ্য হিসেবে বইখানি বিশ্বের সুধী সমাজের বিস্ময়দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কৃতীয় সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ জনাব ইব্রাহীম খা বইখানি তরজমা করেছেন। এ দিক দিয়ে ফ্রাঙ্কলিন উপযুক্ত লোকই বেছে নিয়েছেন বলা চলে।
এ পর্যন্ত লিখিত অধিকাংশ আধুনিক ইতিহাসেই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগীর পরিচয় কমই পাওয়া গেছে। এর মূলে হয়তো রয়েছে, ইতিহাসের পটভূমি সম্পর্কে যথার্থ তথ্যানুসন্ধানে ব্যর্থতা অথবা ইতিহাসের সাথে সংশ্লিষ্ট জাতি সম্পর্কে ইতিহাসকারের অনুদার মনোভাব বা এক দেশদর্শিতা। মুসলমানদের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই সংকীর্ণ মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে, তাদের সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস পাওয়া দুস্কর। এ দিক দিয়ে হিট্টির ইতিহাসকে অপেক্ষাকৃত অধিক নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ মনে করা হয়। তা সত্ত্বেও তার ইতিহাসের সব কিছুই যে নির্ভুল ও নিখুঁত, এ কথা জোরের সাথে বলা চলে না। এ বিষয়ের প্রতি আমাদের ইতিহাসবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আলোচ্য গ্রন্থের তথ্যে কোন ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে অবহিত করানো হলে, আশাকরি পরবর্তী সংস্করণে কর্তৃপক্ষ তা সংযোজন করার ব্যবস্থা করবেন।
‘আরব জাতির ইতিকথা’ প্রকাশিত হওয়ার ফলে পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্যের ঐশ্বর্য ভাণ্ডার নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধতর হয়েছে। আশাকরি, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন পূর্ব-পাকিস্তানের পাঠক সমাজে বইখানি ব্যাপক সমাদর লাভ করবে।
(মওলানা) মুস্তাফিজুর রহমান
মাদ্রাসা-ই-আলীয়া, ঢাকা
১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫৮
০১. আরব-জাতি, মুসলিম ও সিমাইট
আরব-জাতি, মুসলিম ও সিমাইট
হযরত মুহম্মদের (সঃ) ইন্তিকালের একশ বছর পর তাঁর অনুগামীরা এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। রোম যখন তার উন্নতির শীর্ষদেশে অবস্থিত, তার তখনকার সাম্রাজ্যের চেয়েও এ আরব সাম্রাজ্য ছিল বৃহত্তর। বিষ্কে উপসাগর হতে সিন্ধুনদ এবং চীনের সীমান্ত ও আরব সাগর হতে নীলনদের নিম্নভাগের জলপ্রপাত পর্যন্ত ছিল এ বিরাট সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার হাজার হাজার মিনার হতে আরবের পয়গম্বরের নাম সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রোজ পাঁচবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। এই অপূর্ব বিস্তারের যুগে মুসলিম-আরব তার ধর্মে, তার ভাষায়, এমনকি তার শেকেল-সুরতে এত অধিক পরিমাণে বাইরের জাতিকে আত্মস্থ করেছিল, যার নজীর আগের ইতিহাসেও নাই, পরের ইতিহাসেও নাই। গ্রীক, রোমক, অ্যাংলো-স্যাকসন অথবা রাশিয়ানরাও এ প্রভাবের বাইরে রয় নাই।
ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, কালদীয়, আর্মেনীয় এবং ফিনিশীয় জাতি–এদের সবারই পূর্বপুরুষের এই আরব উপদ্বীপের কোলে লালিত হয়েছিল। এরা সবাই এককালে ছিল, আজ আর নাই। আরবেরা ছিল, আজো তারা আছে। তারা বিশ্ব-বাণিজ্যের একটি বিরাট চলাচল পথের মাঝখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে তখনো ছিল, এখনো আছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর হতে ক্রমবর্ধমানভাবে এ জাতি তাদের অতিত উত্তরাধিকার এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের আগ পর্যন্ত, আরব জাহানের সমস্ত পূর্ব-ভাগ তুর্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বৃটিশ শক্তির আওতায় অছি রাজ্য হিসেবে কিছুকাল শিক্ষানবিশী করার পর ইরাক আজ সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার রাজা একজন আরব, তার রাজধানী বাগদাদ–এককালে আরব্য-উপন্যাস খ্যাত হারুনর রশীদের শাসনাবাস। ফিনিশীয় যুগ হতে লেবানন সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য অভিমুখী; আজ খৃষ্টানরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। লেবানন ফরাসীদের অছি-রাজ্য থাকাকালেই নিজেকে রিপাবলিক বলে ঘোষণা করেছে। এর রাজধানী বৈরুত এখন এশিয়ার সব চেয়ে আধুনিক ও সব চেয়ে কর্মব্যস্ত নগরসমূহের অন্যতম। লেবাননের প্রতিবেশী সিরিয়া। সিরিয়াও ফরাসীদের মুরুব্বিয়ানা হতে অব্যাহতি পেয়ে এক আযাদ রিপাবলিক। উমাইয়া খলীফাদের সেকালের গৌরবময়ী রাজধানী দামেস্ক বর্তমান রিপাবলিকেরও রাজধানী। কিছুকাল বৃটিশ অছি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকার পর জর্দান এখন মহানবীর জনৈক বংশধরের অধীনে হাশেমী রাজ্যরূপে গড়ে উঠেছে। আধুনিক আরবের লৌহ-মানব ইবনে সউদ মধ্য, উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব আরব নিয়ে একটা মস্ত সুসংবদ্ধ রাজ্য গড়ে তুলেছেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের পর আরবে আর অমন রাজ্যের উদ্ভব হয় নাই। বহুকাল পর্যন্ত বৃটিশ অধিকার ও প্রভাবে থাকার পর মিসর ষোলআনা আযাদী অর্জন করেছে, তার দেড় শতাব্দীকাল স্থায়ী রাজবংশের শাসন কর্তৃত্ব বর্জন করেছে এবং তার আর্থিক ও সামাজিক সংস্কারের জন্য বৈপ্লবিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। মিসরের প্রতিবেশী সুদান, লিবীয়া, তিউনিসিয়া এবং মরক্কোও পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করেছে। পশ্চিমে আলজেরীয়া আরব জাতীয়তার অপূর্ব স্পন্দনে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে এবং বর্তমানে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সগ্রামে লিপ্ত রয়েছে।