গভীর আনন্দের কথা যে, এ বইয়ের একটা বাংলা সংস্করণও এখন আত্মপ্রকাশ করছে। বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপুঞ্জের ইন্দো-আর্য উপ-গোত্রের অন্তর্ভুক্ত দূর প্রাচ্যের ভাষা সমষ্টির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ভাষা। ধর্মীয় ও সাহিত্যিক চিন্তাধারার বাহন হিসেবে এ ভাষার সুদীর্ঘ ও মহত্তম ঐতিহ্য রয়েছে।
ফিলিপ কে. হিট্টি
১লা এপ্রিল ১৯৫৭
.
গ্রন্থকার-পরিচিতি
ইতিহাসবেত্তা হিসেবে ডক্টর ফিলিপ কে, হিট্টি আজ বিশ্ব-বিশ্রুত। আরব জাতির ইতিহাস সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা এবং বিশ্ব-সভ্যতায় আরবদের যুগান্তকারী অবদান আর তাদের উত্থান-পতনের বৈচিত্র্যময় জীবনালেখ্যের ওপর নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে আলোকপাত করে এই শক্তিমান জাতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি নব পরিচয়ের দ্বার উদ্ঘাটন করেছেন। শুধু তাই নয়, আরব জাতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান এবং সুদূর অতীতের বেলাভূমিতে তাদের পূর্বপুরুষদের বলিষ্ঠ পদ-চিহ্ন খুঁজতে যেয়ে ইতিহাসের যে বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসায় হিট্টি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন আজ ইতিহাস সাধনার ক্ষেত্রে তা একটি নব জাগ্রত চেতনার সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে হিট্টি অবসরগ্রহণ করেন। গত তিন দশক থেকে আরবী এবং ইসলামী ভাষা ও সভ্যতার গবেষণায় তিনি আমেরিকার শ্রেষ্ঠতম মনীষীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তার মহত্তর প্রচেষ্টার ফলেই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় আজ আরবী পাণ্ডুলিপির একটি অমূল্য সহ-ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ হয়েছে। এ দিক থেকে প্রিন্সটন সমগ্র আমেরিকায় শ্রেষ্ঠতম গৌরবের অধিকারী। ১৯৫২ সালে তাঁরই উদ্যোগে প্রিন্সটন ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি বৃহৎ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। ডক্টর হিট্টির ব্যাপক প্রভাব এবং পথ-নির্দেশের ফলে আমেরিকার বহুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে (কমপক্ষে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি) আরবী ভাষা, নিকট প্রাচ্য ও আরব ভূমির ইতিবৃত্ত, ইসলামী ইতিহাস, দর্শন, কৃষ্টি ও সভ্যতা সংক্রান্ত বিষয়াদি পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়েছে।
১৮৮৬ সালের ২৪ জুন লেবাননে হিষ্টির জন্ম হয়। ১৯০৮ সালে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি বি. এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯১৩ সলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯২০ সালে নিয়মিতভাবে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯০৯ হতে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক পদে কাজ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিটিক সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হন।
বর্তমানে তিনি ইরানী শিল্প ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কিত আমেরিকান ইন্সটিটিউটের জাতীয় উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য, সমাজ-বিজ্ঞান বিশ্বকোষের সম্পাদনা বিভাগের উপদেষ্টা, ‘বাইজেনটিয়ন’-এর সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য। লেবানন সরকার তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৬ সালে “লা মেডেইলে দ্য অনার দু’ মেরিটে লিবানাইজ ইন ভারমেইল, অফিসার দ্য ওয়ান; অর্ডার দু সেডরে” নামক প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার পদক দ্বারা তাকে সম্মানিত করেন। ১৯৪০ সালে আমেরিকান বিশ্ব প্রদর্শনীতে আমেরিকায় নাগরিকত্ব প্রাপ্ত প্রখ্যাত মনীষীদের নামের সাথে তার নাম প্রস্তর ফলকে উল্কীর্ণ করা হয়। শিলা-গাত্রে কীর্তিমান এই মনীষীদের প্রতিভার অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর অঙ্কিত করে লেখা হয় যারা আমাদের জাগ্রত ও ক্রমপ্রসারণশীল গণতন্ত্রকে অক্ষয় অবদানে সমৃদ্ধ করেছেন।
ডক্টর হিট্টির ‘আরব জাতির ইতিকথা’ বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থসমূহের অন্যতম। লন্ডন ও নিউইয়র্ক হতে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত এর বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বহু প্রভাবশালী ভাষায় অনুবাদ সংস্করণ আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু মূল ইংরাজী সংস্করণেরই লক্ষাধিক কপি বিক্রয় হয়েছে।
বর্তমানে ডক্টর হিট্টি তাঁর পত্নী ও কন্যাসহ প্রিন্সটনে বাস করছেন।
.
অগ্র-লেখা
মুসলমানদের গৌরবের স্বর্ণোজ্জ্বল যুগ খৃস্টীয় অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ হতে নবম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত একশো বছরকে বলা হয়, তরজমার যুগ। এ সময় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নব জাগ্রত মুসলিম মনীষীগণ গ্রীক, ল্যাটিন, পাক-ভারতীর প্রভৃতি ভাষার বহু মূল্যবান জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থের তরজমা করেন। তাদের এই মহত্তর প্রচেষ্টার ফলে আরবী সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্রতর সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই অগ্রগতির ক্ষেত্রে জ্ঞানসাধক খলিফাগণ ও তাদের ওমরাহদের অবদানও অনেকখানি। এঁদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ও ঐকান্তিক আগ্রহের ফলে মুসলিম মনীষীদের সাধনার পথ সুগম হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তাধারার সাথে মুসলমানদের পরিচয় ঘনিষ্ঠত হয়। সে সময় এদের প্রচেষ্টায় উন্নত ধরনের যে সব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে, যে সব মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়–আর যে সব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়, তা চিরকালই মানুষের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করবে এবং মানব জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় কীর্তি হয়ে বেঁচে থাকবে।