মুসা তার ক্ষুদ্র সহকারীর এই অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে ১০ হাজার সৈন্যসহ ৭১২ সালের জুন মাসে স্পেন অভিমুখে ধাবিত হলেন। এ সৈন্যদের সবাই ছিল আরব ও সিরিয়া হতে সংগৃহীত। তিনি সেই সব শহর ও দুর্গ বিজয়ের জন্য বেছে নিলেন যেগুলি তারিক এড়িয়ে গিয়েছিলেন । মেডিনা, সিডোনীয়া ও কারমোনা। সেভিলে ছিল স্পেনের সবচেয়ে বড় শহর এর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং এককালের রোমক রাজধানী। মুসা সেভিল অবরোধ করলেন। ৭১৩ সালের জুন পর্যন্ত অবরোধ চল্প। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম করতে হল মেরিডা জয় করতে। এক বছর অবরোধের পর ৭১৩ সালের ১ জুন মেরিডা অধিকৃত হয়।
টলেডো শহরে বা তার নিকটবর্তী কোন স্থানে মুসা ও তারিকের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটে। কথিত হয়, তারিকের বিজয় অভিযানের প্রথম দিকে মুসা তাকে আর অগ্রসর হতে নিষেধ করেন; কিন্তু তারিক সে আদেশ মান্য করেন নাই। সেই অপরাধে মুসা এই সাক্ষাৎকালে তারিককে বেত্রাঘাত করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন। কিন্তু বিজয় অভিযান রুদ্ধ হল না। অল্পকাল মধ্যেই উত্তরে সারাগোসা পর্যন্ত ইসলামী ঝাণ্ডা উড্ডীন হল এবং মুসলমান সৈন্যরা আরাগন, লিয়ন, অরিয়াস এবং গ্যালিসিয়ার উচ্চ ভূমিতে প্রবেশ করল। সেই বছরেরই শরৎকালে খলীফা ওলীদ মুসাকে সুদূর দামেস্কে ডেকে পাঠালেন–সেই একই অপরাধে, যে অপরাধে মুসা নিজ অধীনস্থ তারিককে শাস্তি দিয়েছিলেন ও তার মনীবের বিনা আদেশে স্বাধীনভাবে কাজ করার অপরাধে।
মুসা তার দ্বিতীয় পুত্র আবদুল আজীজকে নব-বিজিত রাজ্যের শাসন-ভার দিয়ে ধীরে ধীরে স্থলপথে দামেস্কের পানে চল্লেন। তাঁর সঙ্গে চল্প তার অফিসার মণ্ডলী, চারশত ভিসিগথ বংশীয় শাহ্জাদা–তাদের মাথায় রাজমুকুট, তাদের কোমরে সোনার কোমরবন্দ-অগণ্য গোলাম ও যুদ্ধবন্দী এবং অফুরন্ত লুষ্ঠিত ধন-রত্ন। আরব ঐতিহাসিকেরা উত্তর আফ্রিকার পশ্চিম হতে পূর্ব পর্যন্ত এই বিজয়-শোভাযাত্রার কথা অতি আনন্দের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনা পাঠককে প্রাচীনকালে বিজয়ী রোমক বীরদের বিজয় কুচকাওয়াজের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই বিরাট শোভাযাত্রা দামেস্কে পৌঁছার আগেই তার খবর দামেস্কে গিয়ে পৌঁছল। খলীফা ওলীদ তখন রোগশয্যায় শায়িত। তাঁর ভাই সোলায়মান তার উত্তরাধিকারী। মুসা টাইবেরিয়াসে উপস্থিত হয়ে সোলায়মানের আদেশ পেলেন : রাজধানীতে দেরীতে প্রবেশের প্রতীক্ষায় ঐখানে অপেক্ষা করুন। ভাবী খলীফা ভেবেছিলেন, ওলীদ শীঘ্রই ওপরে চলে যাবেন; তখন তার সিংহাসন-আরোহণের উৎসবের মধ্যে শোভাযাত্রা রাজধানীতে প্রবেশ করবে।
রত্ন-ঝলমল পোশাক পরিহিত ভিসিয়োগ-বংশীয় শাহ্জাদাদের সঙ্গে নিয়ে মুসা ৭১৫ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে দামেস্কে প্রবেশ করলেন। মনে হল, ওলীদ খুশীর সঙ্গেই তার বিজয়ী সেনাপতিকে গ্রহণ করলেন। মহান উমাইয়া মসজিদে যে বিপুল সম্ভ্রম ও ধূমধামের সঙ্গে অভ্যর্থনার উৎসব সম্পন্ন হল, তা বিজয়ী ইসলামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল গৌরব-স্তম্ভ। এই প্রথম ইউরোপীয় শাহজাদা ও হাজার হাজার ইউরোপীয় বন্দীকে আমীরুল মুমিনিনের সম্মুখে বশ্যতা স্বীকারের শপথ গ্রহণ করতে দেখা গেল।
মুসা খলীফাকে অন্যান্য মূল্যবান জিনিসের মধ্যে একটি অপূর্ব কারুকার্য খচিত টেবিল নজর দিলেন। প্রাচীন কাহিনী বলে, বাদশাহ্ সোলায়মান জ্বীন মিস্ত্রী দ্বারা এই টেবিল নির্মাণ করিয়েছিলেন। কাহিনীতে আরো পাওয়া যায় যে, রোমকরা বায়তুল মোকাদ্দেস হতে এই টেবিল তাদের নিজ রাজধানীতে চালান দেয় এবং পরবর্তীকালে সেখানে হতে গথরা এ টেবিল নিয়ে যায়। প্রত্যেক গহ্ রাজা তার পূর্ববর্তী রাজার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বহু মূল্য রত্নরাজিতে এ টেবিল সুশোভিত করতেন। রাজধানীর প্রধান গীর্জায় এই অমূল্য টেবিল রক্ষিত ছিল, বোধহয় কোন পুরোহিতের নিয়ে পলায়নের সময় তারিক তার নিকট হতে উদ্ধার করেন। টলেডোতে যখন মুসার সঙ্গে তারিকের সাক্ষাৎ হয়, তখন মুসা তারিককে বেত মারার সঙ্গে সঙ্গে টেবিলটিও কেড়ে নেন। কিন্তু তারিক নাকি চুপে চুপে একটি পায়া সরিয়ে ফলেন এবং এখন খলীফার সামনে নাটকীয়ভাবে হারান পায়াটি উপস্থিত করেন : টেবিলটি যে আসলে তিনিই সগ্রহ করেন, তারই প্রমাণ স্বরূপ।
অনেক করিৎকর্মা আরব সেনাপতির ভাগ্যে যা ঘটেছে, মুসার ভাগ্যেরও তা-ই ঘটল। ওলীদের পরবর্তী খলীফা তাঁকে অপদস্থ করলেন। রোদে হয়রান হয়ে ভেঙ্গে না পড়া পর্যন্ত তাঁকে খোলা আকাশতলে দাঁড়িয়ে রাখা হল। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হল; তাঁকে সর্ব ক্ষমতা হতে বঞ্চিত করা হল। তার সম্বন্ধে আমরা যে শেষ সংবাদ পাই তা এই যে, হেজাজের এক দূর পল্লীতে এই বৃদ্ধ আফ্রিকা-স্পেন বিজয়ী বীর ভিক্ষা করে জীবনযাপন করেছেন।
স্পেন এখন খেলাফতী-সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে পড়ল। এর আরবী নাম দেওয়া হল, আল-আন্দালুস। ভ্যাণ্ডাল শব্দের সঙ্গে আন্দালুসের ব্যুৎপত্তিগত যোগ আছে। আরবদের স্পেন অধিকারের আগে ভ্যাণ্ডালরা স্পেন অধিকার করেছিল। মুসার পরবর্তী শাসকদের জন্য স্পেনের উত্তর এবং পূর্বভাগে অল্প স্থানই দখলের বাকী ছিল; বিদ্রোহ দমনও বেশি করতে হয় নাই। মধ্যযুগীয় ইউরোপে স্পেন ছিল সুন্দরতম ও বৃহত্তম অঞ্চল সমূহের অন্যতম। মাত্র সাত বছর সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলের বিজয় পরিপূর্ণ হল। বিজেতারা অতঃপর কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্পেনের ভাগ্যবিধাতা হয়ে রইল।