উত্তর কেন্দ্রীয় সীমান্তে আরব বিজয়-তরঙ্গ কনস্টান্টিনোপলের দুর্গ-মূলে প্রহত হয়ে ফিরে আসে। তবে এই যুগে আরবরা যে কনস্টান্টিনোপল বছর-কাল পর্যন্ত (৭১৬’র আগস্ট হতে ৭১৭’র সেপ্টেম্বর) অবরোধ করে রাখে, তা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। গোল্ডেন হর্নের মুখে একটি বিরাট শিকল টানিয়ে আরব নৌ-বাহিনীর প্রবেশপথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু পশ্চিমদিকের অভিযানেই মুসলমানেরা সবচেয়ে বিস্ময়কর বিজয় লাভ করে। তারা আগেই উত্তর আফ্রিকায় প্রাচীন কার্থেজের সীমা পর্যন্ত তাদের অধিকার বিস্তার করেছিল। তখন উত্তর আফ্রিকার একাংশের বাসিন্দা ছিল বার্বার জাতি। এরা শ্বেতাঙ্গ জাতিদের এক হেমিটিক শাখা ছিল। ইতিহাস-পূর্ব যুগে। হয়তো এরা সিমাইটদের সঙ্গে একই মূল জাতি হতে উদ্ভূত হয়েছিল। উপকূল ভাগের বেশীর ভাগ বার্বাররাই খৃস্টানধর্ম গ্রহণ করেছিল। টার্টুলিয়ান, সেন্টসাইপ্রিয়ান, সর্বোপরি সেন্ট অগস্টাইন–এরা প্রাথমিক খৃস্টান পুরোহিত সমাজে দিপাল ছিলেন এবং এঁদের প্রত্যেকেই এই বার্বারদের মধ্য হতে উদ্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু উপকূল হতে ভিতরের অংশের বাসিন্দারা রোমক বা বাইজেন্টাইন সভ্যতা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয় নাই। আসলে উত্তর আফ্রিকার এ যাযাবর এবং অর্ধ-যাযাবর জাতি-সমূহের মনোবৃত্তির কাছে রোমক ও বাইজেন্টাইন সভ্যতা কখনো আপন বলে অনুভূত হয় নাই। ইসলামের একজন মহাশক্তিশালী সেনাপতি মুসা-ইবনে নুসাইয়ার এই বার্বারদের মধ্য দিয়ে তার বিজয়-রথ চালিয়ে যান।
বার্বাররা তখন সভ্যতার যে স্তরে অবস্থিত, সে স্তরের লোকের কাছে ইসলামের এক বিশেষ আকর্ষণ ছিল। কাজেই সেমিটিক আরবরা সহজেই তাদের হেমিটিক জ্ঞাতি ভাইদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ পেতে বসল। ইসলাম আবার এক মহাআশ্চর্যজনক সাফল্য লাভ করল? অর্ধসভ্য যাযাবর জাতিদের ভাষায় ছিল তারা আরবী, আর ধর্মে ছিল তারা ইসলাম। বিজেতাদের রক্ত নতুন রক্তের সহযোগে উজ্জীবিত হয়ে উঠল। আরবী ভাষা নিজ বিজয়ের জন্য পেল এক বিরাট ক্ষেত্র আর উদীয়মান ইসলাম তার বিশ্ব-প্রভুত্ব স্থাপনের আরোহণ পথে পেল, পা রাখার নতুন স্থান।
আরবরা যে দ্রুতগতিতে এবং যেমন সম্পূর্ণভাবে স্পেন অধিকার করে, তা মধ্যযুগীয় সামরিক ইতিহাসে এক অতুলনীয় স্থান অধিকার করে আছে। ৭১০ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক অভিযান শুরু হয়। ৪ শত পদাতিক ও ১ শত অশ্বারোহী এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে। এরা জাতিতে সবাই বার্বার এবং মুসার সৈন্যদল-ভুক্ত ছিল। মুসা উমাইয়া খলীফাদের অধীনে উত্তর আফ্রিকার গভর্নর ছিলেন। আক্রমণকারী সৈন্যদল তারিফা নামক ক্ষুদ্র উপদ্বীপে অবতরণ করে। তারিফাঁকে ইউরোপের সর্বদক্ষিণ ডগা বলা যেতে পারে।
মুসা ৬৯৯ খৃস্টাব্দ হতে উত্তর আফ্রিকার গভর্নর ছিলেন। কার্থেজের পশ্চিম অঞ্চলের সমস্ত ভূ-ভাগ হতে তিনি বাইজেন্টাইনদের চিরতরে বিতাড়িত করেন। এবং ক্রমে তার বিজয় অভিযান আটলান্টিকের উপকূলভাগে গিয়ে পৌঁছে। এইরূপে তিনি ইউরোপে মুসলিম অভিযান-পথ খোলাসা করেন। মুসার প্রাথমিক স্পেনীয় অভিযান সাফল্যমণ্ডিত হয়। স্পেনের তত্ত্বালীন ভিসিয়োগথ রাজাদের মধ্যে বংশগত দ্বন্দ্ব জেগে ওঠে। এ উভয় কারণে উৎসাহিত হয়ে এবং রাজ্য জয়ের চেয়ে লুণ্ঠন আশায় অধিকতর প্রলুব্ধ বোধ করে ৭১১ খৃস্টাব্দে মুসা তারিককে ৭ হাজার সৈন্য-সহ স্পেন বিজয়ে প্রেরণ করেন। তারিক জাতিতে বাবার এবং মুসার আজাদী দেওয়া লোক ছিলেন তার সৈন্যদের অধিকাংশই বার্বার জাতীয় ছিল। তারিক এক পাহাড়ের উপর অবতরণ করেন। এই পাহাড় জিব্রাইটার (জবল-আল-তারিক-অর্থাৎ তারিক পাহাড়) নামে তারিককে অমর করে রেখেছে। এখানে প্রণালীটি পাশে মাত্র তের মাইল। কথিত আছে, সিউটার গভর্নর কাউন্ট জুলীয়ান তারিকের নৌ-বহরের রসদ-পত্র জোগান।
পথে আরো কিছু সৈন তারিকের সঙ্গে যোগ দেয়। এইরূপে বর্ধিত বার হাজার সৈন্য নিয়ে ৭১১ খৃস্টাব্দের ১৯ জুলাই তারিক সালাদো নদীর মুখে রাজা রডারিকের সম্মুখীন হন। রডারিক উইটিজার পুত্রকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজে সিংহাসনে বসেন। রডারিকের সৈন্য সংখ্যা ২৫ হাজার হওয়া সত্ত্বেও তারা ভীষণভাবে পরাজিত হয়। রডারিকের ভাগ্যে অতঃপর কি ঘটে, তা আজো প্রহেলিকা হয়ে আছে। স্পেনীয় ও আরব ঐতিহাসিকেরা কেবল এইটুকু বলেই তুষ্ট যে, রডারিক উধাও হয়ে গেলেন।
এই চূড়ান্ত বিজয়ের পর মুসলমানেরা স্পেনময় কেবল যেন বেড়িয়ে বেড়িয়ে এগিয়ে গেল। কোথাও উল্লেখযোগ্য লড়াই আর কিছুই হল না। কেবল যেসব শহরে ভিসিয়োগহ্ নাইটদের প্রভুত্ব ছিল, সেখানে তারা যথেষ্ট বাধা দিল। তারিক সৈন্যদলের প্রধান অংশ-সহ ইসিজার পথে রাজধানী টলেডোর দিকে অগ্রসর হলেন; বাকী সৈন্যগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে বিভিন্ন শহরের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। দক্ষিণে সেভিল শহর দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত ছিল; সে শহর আরব সৈন্যরা এড়িয়ে গেল। এক দল আর্কিদোনা অবরোধ করল; আর্কিদোনা বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পণ করল। আর একদল আল-ভীরা দখল করল। তৃতীয় দলে অশ্বারোহী ছিল। এ দল মুসলমানদের ভবিষ্যৎ রাজধানী কর্ডোভা অবরোধ করে বসল। দুই মাস পর্যন্ত অবরোধ চল্ল। কথিত আছে, এরপর এক বিশ্বাসঘাতক রাখাল দুর্গের ভগ্ন প্রাচীর দেখিয়ে দেয় এবং তার ফলে কর্ডোভার পতন হয়। মালাগা কোন বাধাই দিল না। ইসিজায় হল এ অভিযানের সবচেয়ে ভীষণ লড়াই এবং পরিণামে আরবরাই জয়লাভ করল। কয়েকজন ইহুদীর বিশ্বাসঘাতকতায় রাজধানী টলেডোর পতন হল। এইরূপে তারিক ৭১১ খৃস্টাব্দের বসন্তকালে একটা অতর্কিত আক্রমণের নেতা হিসেবে শুরু করে গ্রীষ্মকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত অর্ধ স্পেনের অধীশ্বর হয়ে বসলেন। একটা সমগ্র রাজ্যকে তিনি ধ্বংস করে ফেলেন।