আলীর হাত হতে যিনি খিলাফত কেড়ে নেন, তিনি ছিলেন আলীরই এক দূরসম্পৰ্কীয় চাচাতো ভাই : ধূর্ত মুয়াবীয়া সিরিয়ার শাসনকর্তা। তার আমল হতে ইসলামের সার্বভৌম ক্ষমতায় এক নব-নীতির প্রবর্তন হয়? খিলাফত বংশগত হয়ে পড়ে। নির্বাচন-প্রথা বিলুপ্ত হয়। আমাদের আলোচ্য যুগে তিনটি বংশের কথা আসবে। উমাইয়া বংশ : ৬৬১ সালে দামেস্কে মুয়াবীয়া–এর শাসন-আমলের পত্তন করেন; বাগদাদের আব্বাসীয় বংশ (৭৫০-১২৫৮) এবং কায়রোর ফাতেমীয় বংশ (৯০৯–১১৭১)। উমাইয়া খলীফাদের এক সুবিখ্যাত শাখা স্পেনে কর্দোভা নগরকে রাজধানী করে ৯২৯ হতে ১০৩১ পর্যন্ত স্পেন শাসন করেন। এই খলীফাদের মধ্যে একমাত্র ফাতেমীয় খলীফারা আলীর বংশধর বলে দাবী করতেন। বংশগত উত্তরাধিকারের নীতি রাজনৈতিক ব্যাপারে খানিকটা স্থায়িত্ব আনয়ন করেছিল। বাস্তবিক পক্ষে কিন্তু রক্তাক্ত আত্মকলহ ইসলামকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে নাই, এমন কোন দীর্ঘযুগ ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন-কোন সময় খলীফা নামে সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেও কার্যতঃ নিজ রাজধানীতেও তাঁর ষোলআনা কর্তৃত্ব থাকত না।
মুয়াবীয়ার অভ্যুদয় উপলক্ষে এই সময় ইসলামের রাজনীতিতে আর এক নতুন সুর বেজে ওঠে। পরবর্তী যুগে মুসলিম-জগতে বহুবার এইসব ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
ইরাকের অধিবাসীরা আলীর পুত্র ইমাম হাসানকে খলীফা বলে ঘোষণা করল। তারা বলু-হাসান আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মহানবীর কন্যা ফাতিমার গর্ভজাত। সুতরাং, যুক্তি অনুসারে তিনিই খিলাফতের অধিকারী।
মুয়াবীয়া অসাধারণ শাসন-কুশলী ব্যক্তি ছিলেন। বিশৃঙ্খলতার ভিতর হতে তিনি একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তোলেন। মুসলিম যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাসে তারই ছিল প্রথম সুশিক্ষিত এবং সুশৃঙ্খল সৈন্যবাহিনী। মুসলিম ঐতিহাসিকরা আরো বলেন যে, ইসলামের তিনিই প্রথম রেজেন্ত্রী দত্তর স্থাপন করেন এবং তিনিই প্রথম পোস্টঅফিস স্থাপন করেন। তাঁর এই প্রতিষ্ঠান অনতিকাল মধ্যে বিকাশ লাভ করে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশকে সুসংবদ্ধ করে।
মুয়াবীয়ার মধ্যে রাজনৈতিক জ্ঞান যে পরিমাণে বিকাশ লাভ করেছিল, তেমন বোধহয় কোন খলীফার মধ্যে বিকাশ লাভ করে নাই। আরব জীবনী লেখকদের বিবেচনায় তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ ছিল ‘হিম’। হিমকে বুদ্ধির কলা কৌশল বলে অনুবাদ করা যেতে পারে। হিল্ম সেই অসাধারণ শক্তি যার বলে মানুষ কেবল তখনি বল প্রয়োগ করে যখন বল প্রয়োগ ছাড়া আর কোন পথই খোলা থাকে না; অন্যান্য সর্বপ্রকার অবস্থায় শান্তিপূর্ণ পথ অবলম্বন করে। মুয়াবীয়া পরম বিচক্ষণতার সঙ্গে মোলায়েম ব্যবহার দ্বারা শত্রুকে আপন করতে চেষ্টা করতেন। তিনি তাঁর ক্রোধ দমন করে চলতেন কোন অবস্থাতেই তিনি আত্মসংযম হারাতেন না; ফলে যে কোন পরিস্থিতিতে তার কর্তৃত্ব বহাল থাকত। তিনি বলেছেনঃ ‘যেখানে আমার চাবুক যথেষ্ট, সেখানে আমি তলোয়ার ধরি না; যেখানে আমার জিভ যথেষ্ট, সেখানে আমি চাবুক হাতে নেই না। আর একটি চুলও যদি আমাকে আমার দেশের ভাইয়ের সঙ্গে বেঁধে রাখে, তবে আমি তা ছিড়ি না। যখন তারা টানে আমি ঢিলা দেই, আর যদি তারা ঢিলা দেয়, আমি টানি।’ কথিত আছে, তিনি ইমাম হাসানকে তাঁর খিলাফত দাবী পরিত্যাগ উপলক্ষে এই মর্মে পত্র লেখেন : ‘আমি স্বীকার করি, রক্তের সম্বন্ধ হিসেবে এ মহান পদের জন্য আপনার দাবীই অগ্রগণ্য। এ পদের গুরুদায়িত্ব পালনে আপনি শ্রেষ্ঠতম ক্ষমতার অধিকারী–এ বিষয়ে নিশ্চিত হলে আমি অসঙ্কোচে আপনার হাতে বয়েত হতাম। এখন তা হলে ঠিক করুন, আপনি কি করবেন।’ এই পত্রের সঙ্গে মুয়াবীয়ার দস্তখত-সহ একখণ্ড সাদা কাগজ ছিল–ইমাম হাসানের পূরণের জন্য। প্রতিদ্বন্দ্বী ইমাম হাসান এ-পত্র পেয়ে স্বভাবতঃই মুগ্ধ হলেন।
পরবর্তী খলীফাদের মত মুয়াবীয়া বাইজেন্টাইনদের সঙ্গে বাহুবল পরীক্ষা করেন এবং দুই দুইবার তাঁর সবল বাহু কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত প্রসারিত হয়। যখন তিনি সিরিয়ার গভর্নর, তখন মুসলিম নৌ-বাহিনী এশিয়া মাইনরের নিকটস্থ লিসীয়ার উপকূলের অদূরে বাইজেন্টাইন নৌ-বাহিনীর সঙ্গে এক রক্তাক্ত সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে জয়লাভ করে। ইসলামের ইতিহাসে এই-ই প্রথম উল্লেখযোগ্য নৌ-বিজয়। কনস্টান্টিনোপল তুর্কদের আগ পর্যন্ত দুর্ভেদ্যই রয়ে যায়। এশিয়া মাইনরেও আরবরা কখনো স্থায়ী প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারে নাই, কিংবা হেলেস্পন্ট পার হতে পারে নাই। তাদের প্রদান শক্তি নিয়োজিত হয়, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে। মুয়াবীয়ার আমলে আবার তারা অভিযান পথে বের হয়।
০৮. স্পেন বিজয়
সিরিয়া, ইরাক, পারস্য ও মিসর অধিকার ইসলামের বিজয়-ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় সূচনা করে। এরপর কিছুকাল আত্মকলহে কেটে যায়। তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় অধ্যায়।
দুর্নিবার ঘূর্ণিবার্তার মত এক প্রচণ্ড অভিযান মহানবীর পতাকাকে অক্সাস নদীর ওপার বহন করে নিয়ে যায়। এই অক্সাসই ছিল পারস্যভাষী ও তুর্কীভাষী দেশসমূহের মধ্যে সনাতন সীমারেখা। ক্রমে ইসলামের বিজয়-কেতন বহির্মঙ্গোলীয়া পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। বোখারা, তাশক, সমরকন্দ,–সমস্ত মুসলিম বাহিনীর সম্মুখে আত্মসমর্পণ করে। মধ্য-এশিয়ায় মুসলিম আধিপত্য এমন দৃঢ়ভাবে সংস্থাপিত হয় যে, চীন জাতিও হস্তক্ষেপ করতে বিরত হয়। আর একটি পূর্ব-গামী বাহিনী দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয় এবং যাকে এখন আমরা বলি বেলুচিস্তান, তারই ভিতর দিয়ে গিয়ে ৭১২ সালে সিন্ধু দেশ অধিকার করে। দক্ষিণ পাঞ্জাবস্থিত মুলতানে তখন এক সুবিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির ছিল। মুসলিম বিজয় ক্রমে এই মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে এবং ভারতের সীমান্ত প্রদেশসমূহে ইসলাম চিরতরে শিকড় গেড়ে বসে। (এইসব বিজয় মাত্র কয়েক বছর আগে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাস্তব রূপ গ্রহণ করেছে। এখানে ইসলাম এক নব সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে–বৌদ্ধ সংস্কৃতি।