আমরা বর্তমানে যাকে আরব-সভ্যতা বলি, তা মৌলিক-গঠন বা জাতিগত বৈশিষ্ট্য–এর কোন দিক দিয়ে আরবীয় ছিল না। খাঁটি আরবীয় অবদান ছিল ভাষাগত এবং কতকাংশ ধর্মগত। খিলাফত-জামানার শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সিরিয়া, পারস্য ও মিসরের বাসিন্দা ও অন্যান্যরা (যেমন নব দীক্ষিতেরা অথবা খৃস্টান ও ইহুদীরা) সভ্যতার পতাকা বহনকারীদের মধ্যে সর্বাগ্রগামী ছিল–যেমন, বিজিত গ্রীকরা ছিল বিজেতা রোমকদের অধীনে। আরব-ইসলামী সভ্যতার মূলে ছিল গ্রীক প্রভাবপুষ্ট আরামেইক ও ইরানী সভ্যতা। এ-সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল খলীফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বিস্তার লাভ করেছিল আরবী ভাষার মাধ্যমে। অন্য কথায়, “উর্বর হেলাল-অঞ্চল’ যে সেমিটিক সভ্যতা আসিরিয়া-ব্যাবিলোনীয়, ফিনিশীয়, আরামীয় ও ইহুদীদের দ্বারা উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছিল, আরব-সভ্যতা তারই অনিবার্য পরিণতি। এ-সভ্যতায় পশ্চিম এশিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতা তার চরম উৎকর্ষ লাভ করে।
মুসলিম-আরব কি শ্রেণীর মানুষ পয়দা করেছিল, আমরা তার দুটি স্পষ্ট ছবি পাই প্রথম দুই খলীফা–আবুবকর (রাঃ) (৬৩২-৬৩৪) এবং ওমরের (রাঃ) (৬৩৪৬৪৪) মধ্যে। আবুবকরই প্রকৃতপক্ষে আরব জয় করেন ও আরবে শান্তি স্থাপন করেন। অথচ তিনি প্রাচীনকালের কওমী সর্দারের মত অনাড়ম্বর সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি তাঁর পত্নী বিবি হাবীবার সঙ্গে আল-সুনহ নামক স্থানে একটি ছোট বাড়ীতে বাস করতেন এবং এই স্থান হতে তার শাসন কালের প্রথম ছয়মাস তিনি রোজ রাজধানী মদীনায় আসতেন। এসময় তিনি রাজকোষ হতে কোন বেতন বা ভাতা নিতেন না। (আর আসলে এ সময়ে রাষ্ট্রের তেমন কোন আয়ও ছিল না)। মহানবীর মসজিদের আঙ্গিনায় বসে তিনি যাবতীয় সরকারী কার্য সমাপন করতেন।
তাঁর পরবর্তী খলীফা ওমর (রাঃ) ছিলেন এক প্রতিভাবান অসাধারণ কর্মী পুরুষ। তিনি লম্বা জওয়ান ছিলেন এবং তাঁর দেহে প্রচুর শক্তি ছিল। তিনিও জাকজমক-শূন্য সরল জীবনযাপন করতেন এবং খলীফা হওয়ার পর অন্ততঃ কিছুকাল পর্যন্ত তেজারতী দ্বারা নিজ পরিবার পালন করেন। তিনি জীবন-ভর বেদুঈন শেখের মত একান্ত আড়ম্বরহীনভাবে চলেছেন। মুসলিম ঐতিহাসিকদের বিবেচনায় প্রাথমিক-যুগে হযরত মুহম্মদের (সঃ) পরই ওমরের স্থান। মুসলমান লেখকগণ তার ধর্মপ্রাণতা, তার সুবিচার এবং তার অনাড়ম্বর জীবনযাপন প্রণালীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁরা মনে করেন, খলীফার যেসব গুণ থাকা দরকার, ওমরের মধ্যে তার সব ছিল। ঐতিহাসিকেরা আরো বলেন, তাঁর মাত্র একটি জামা ও একটি আলখিল্লা ছিল এবং তাতে তালির অভাব ছিল না। তিনি খেজুরপাতার বিছানায় শয়ন করতেন এবং তাঁর একমাত্র ধ্যান ছিল–ধর্মের পবিত্রতা সংরক্ষণ, হক-বিচার কায়েম করা এবং ইসলাম ও আরব-জাতির উন্নতিবিধান। ওমরের কঠোর চরিত্র সম্বন্ধীয় উপাখ্যানে আরবী-সাহিত্য ভরপুর। তিনি তাঁর নিজ পুত্রকে সুরাপান ও ব্যভিচারের জন্য দোররা মেরে মেরেই ফেলেছিলেন। একদা এক বেদুঈন কোন জালিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে তাঁর কাছে আসে। তিনি রাগের মাথায় বেদুঈনকে কয়েকটি দোরা মারেন। এরপরই তাঁর অনুতাপ হয়; তিনি বেদুঈনকে ডেকে তার পিঠে সেই কয়েকটি দোরর মারতে বলেন। বেদুঈন অস্বীকার করে। তখন তিনি আপনা আপনি এই বলতে বলতে চলে যান :
‘হে আল-খাত্তাবের পুত্র! তুমি নগণ্য ছিলে, আল্লাহ তোমাকে ইজ্জত দিয়েছেন; তুমি পথ-ভ্রান্ত ছিলে, আল্লাহ্ তোমাকে পথ দেখিয়েছেন; তুমি দুর্বল ছিলে, আল্লাহ, তোমাকে সবল করেছেন। এরপর আল্লাহ্ তোমাকে তোমার জাতির ঘাড়ের উপর শাসক নিযুক্ত করেছেন তাদেরই একজন তোমার কাছে এল সাহায্য চাইতে–আর তুমি তাকে করলে বেত্রাঘাত। আল্লাহর কাছে যখন হাজির হবে, তখন তোমার এ অন্যায়ের কি কৈফিয়ত দিবে।
এ-কথা লক্ষণীয় যে, ওমর নিহত হন পারস্য-দেশীয় এক খৃস্টান গোলামের ছুরিকাঘাতে।
ওমরের পরবর্তী খলীফা ওসমান (রাঃ) বারো বছর শাসন করেন এবং এক বিদ্রোহ-কলে মুসলমানদের হাতে নিহত হন। আলী (রাঃ) (৬৫৬৬৬১) পরবর্তী খলীফা। প্রায় সমস্ত মুসলিম-জগতই তাঁকে স্বীকার করে নেয়; তথাপি একটি বিরুদ্ধ দল শীঘ্র জেগে ওঠে। ফলে রু হয় সেই বংশগত লড়াই, যা পরবর্তীকালে মাঝেমাঝেই মুসলিম-সাম্রাজ্যকে তোলপাড় করেছে এবং কখনো কখনো তার ভিত্তিমূলকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছে। পাঁচ বছর পর এক বিষাক্ত চুরির আঘাতে হযরত আলী (রাঃ) নিহত হন।
এখানে একটি সাধারণ ভুল সম্বন্ধে আমাদের সাবধান হতে হবে : অনেকেই মনে করেন খিলাফত একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। রোম সাম্রাজ্যের এবং ক্যাথলিক চার্চের অধিনায়কের সঙ্গে খলীফাকে এক মনে করা ভুল। খলীফা আমীরুল মুমেনীন : মুমিনদের আদেশদাতা। এ হিসেবে তাঁর পদের সামরিক গুরুত্ব যথেষ্ট। ইমাম হিসেবে তিনি জামাতের ইমামতি ও জুমার নামাজে খোত্বা দিতে পারতেন এবং অনেক সময় বাস্তবিকই খোতবা দিতেন। কিন্তু এ কাজ নিতান্ত নগণ্য মুসলমানকে দিয়েও চলতে পারে। মহানবীর খলীফা হওয়া মানে ছিল, মুসলিম রাষ্ট্রের নায়ক পদে ব্রত হওয়া। গয়গম্বর হিসেবে কারো পক্ষে মুহম্মদের (সঃ) স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথাই ওঠে না। খলীফার সঙ্গে ধর্মের শুধু এইটুকু সম্বন্ধ ছিল যে, তিনি ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক ছিলেন। যেকোন ইউরোপীয় সম্রাটের মত খলীফা ধর্মকে বিধর্মীয় আক্রমণ হতে রক্ষা করতেন, ধৰ্ম-বিরোধী মত দমন করতেন, কাফিরদের সঙ্গে লড়াই করতেন এবং দারুল ইসলামের সীমা বর্ধন করতেন এবং এসব কর্তব্য সম্পাদন করতে তিনি তার ঐহিক বাহুবল প্রয়োগ করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের আগে ইউরাপে এমন কোন ধারণা বদ্ধমূল হয় নাই যে, মুসলিম-খলীফা খৃস্টান-পোপের মত সমগ্র জগতের মুসলমানদের উপর এক ধর্মীয় আধিপত্যের অধিকারী। সুচতুর দ্বিতীয় আবদুল হামিদ খৃস্টান-শক্তিপুঞ্জের চোখে তার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ঐ ধারণার সাহায্যে গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, এই সময় খৃস্টান-শক্তিবর্গ এশিয়া ও আফ্রিকার বেশির ভাগ মুসলিম-রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিগত শতাব্দীর শেষ ভাগে প্যান-ইসলামীজম নামে একটি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এ-আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের মাধ্যমে খৃস্টান-শক্তিকে বাধা দেওয়া। তুরস্ককে এই আন্দোলনের কেন্দ্র করে খিলাফতের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।