আরব ঐতিহাসিকেরা ইসলামের অগ্রগমণকে প্রধানতঃ ধর্মীয় ব্যাপার হিসেবেই বিচার করেছেন। এর পেছনে যে-সব অর্থনৈতিক কারণ সক্রিয় ছিল, তার উপর তাঁরা মোটেই জোর দেন নাই। অন্যপক্ষে, অনেক খৃস্টান লেখক এক অবিশ্বাস্য কাহিনী প্রচার করে বলেছেন যে, আরবীয় বিজেতারা বিজিতদের সামনে তুলে ধরতেন দুই বস্তু হয় কোরআন, না হয় কৃপাণ। আরব উপদ্বীপের বাইরে–বিশেষ করে ইহুদী ও খৃষ্টানদের বেলায়, বিজেতাদের পক্ষ হতে আরো একটি লাভজনক পথ খুলে দেবার ছিল এবং সেটি হল-খাজনা। যুদ্ধ কর…কিতাবীদের সঙ্গে, যে পর্যন্ত তারা নতমস্তকে স্ব-হস্তে খাজনা দেয় (৯ : ২৯)। আরব যোদ্ধাদের ইসলাম একটি যুদ্ধ-ধ্বনি দিয়েছিল, এ কথাও সত্য। যে বিচ্ছিন্ন জনগণ ইতিপূর্বে কোন কালে ঐক্যবদ্ধ হয় নাই, ইসলাম তাদের ঐক্য দান করেছিল। তাদের অদ্ভুত প্রাণশক্তিও অনেকাংশে ইসলামেরই অবদান ছিল। কিন্তু ইসলামের বিজয়াবলীর কারণ নির্ণয়ের জন্য এসব অবস্থা যথেষ্ট নয়। বিজয়ী-বাহিনীর বেশীর ভাগ সৈন্যই বেদুঈন সমাজ হতে সংগৃহীত হত। বেদুঈনদের আর্থিক দুর্গতির অন্ত ছিল না। কাজেই বেদুঈন যোদ্ধাদল যে দিগ্বিজয়ে বের হত, তার কারণ ধর্মোন্মত্ততা ছিল না; তার কারণ ছিল, তাদের উষর বাসভূমির ওপারের উত্তর অঞ্চলের শস্য-শ্যামলা ভূমি অধিকারের অর্থনৈতিক তাগিদ। বেহেশতের স্বপ্ন অনেক যোদ্ধাকে নিঃসন্দেহ রকমে অনুপ্রাণিত করেছিল; কিন্তু সভ্যতায় অগ্রসর সমৃদ্ধিশালী অঞ্চলের বিলাস বৈভবের আকাঙ্ক্ষাও বহুজনকে প্রলুব্ধ করেছিল। যুগ যুদান্তর হতে মরুর ঊষর বক্ষ নির্গত বুভুক্ষ জনগণ ধীরে ধীরে তাদের পার্শ্বস্থ ‘উর্বর-হেলাল’ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছিল। ইসলামের বিস্তার উপলক্ষে সিমাইটদের দেশান্তর গমনের শেষ পর্যায় এভাবে পূর্ণ হল।
এ আমলের ঐতিহাসিকেরা কেউই ইসলামের বিজয় সংক্রান্ত ঘটনাবলীকে স্বাধীনভাবে বিচার করেন নাই–তাঁদের পরবর্তী বিকাশের আলোকে বিচার করেছেন। তারা বলতে চান, বিজয়ের অভিযানগুলি খোলাফা-এ রাশেদীন–বিশেষ করে আবু বকর ও ওমরের সুচিন্তিত পরিকল্পনা মোতাবেক পরিচালিত হয়েছিল। যাদের কার্যকালে বিরাট ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে, তারা সে ঘটনাবলীর প্রবাহ-পথ পূর্ব হতেই সুস্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, এরূপ নজীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইসলামের প্রভাবে এ সময়ে আরবে অন্তর্বিরোধ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়, এই অবরুদ্ধ সগ্রাম স্পৃহার বহির্পথ হিসেবেই আক্রমণ-অভিযানগুলির প্রথম আরম্ভ হয়। এ সব আক্রমণের উদ্দেশ্য অধিকাংশ স্থলেই ছিল লুণ্ঠন, স্থায়ী রাজ্য স্থাপন নয় । কিন্তু লুণ্ঠনের মতলবে যারা এসব অভিযান শুরু করেছিল, কিছুকাল পর এসব অভিযান তাদের নাগালের বাইরে চলে গেল। যোদ্ধারা বিজয়ের পর বিজয় লাভ করে চল্প; তাদের অভিযানেরও শক্তি ও মর্যাদা বাড়তে শুরু করল। এই সময় হতে আরম্ভ হল সুসংবদ্ধ বিজয় অভিযান এবং এর অনিবার্য ফল হিসেবে আরব-সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটল। সুতরাং, আরব-সাম্রাজ্য কোন সুপরিকল্পিত বিজয় অভিযানের ফল নয়; ইহা উপস্থিত অবস্থাবলীর কার্য-কারণ ঘটিত অনিবার্য পরিণতি।
ইহুদী ঐতিহাসিকেরা দাবী করেছেন যে, ইহুদীদের শক্তির বিকাশ ও বিস্তার ওল্ড টেস্টামেন্টের বাণী মোতাবেকই সংঘটিত হয়েছিল। মধ্যযুগীয় খৃস্টান দার্শনিকেরাও অনুরূপ দাবী করেছেন। ইসলামের শাস্ত্রবিদগণেরও কেউ কেউ দাবী করেছেন যে, ইসলামের অভ্যুদয় ও বিস্তার বিধাতার ইচ্ছা অনুসারেই হয়েছে। (এ দাবীর ভিত্তিতে ভাষাগত ভুল আছে)। ইসলাম’ এই শব্দকে তিনটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা চলে : মূলতঃ ইসলাম ধর্ম, তারপর ইসলামী রাষ্ট্র, সবশেষে ইসলামী তমদ্দুন। ইসলাম ইহুদী ও বৌদ্ধ ধর্মের পথে চলে নাই (খৃস্টান ধর্মের মত ইসলাম প্রচারমূলক ধর্ম হয়ে ওঠে)। পরে ইসলাম রাষ্ট্র গড়ে তোলে। যে ইসলাম উত্তর দেশসমূহ জয় করে, সে ইসলাম আসলে ইসলাম ধর্ম নয়, ইসলামী রাষ্ট্র। একটি জাতীয় ধর্ম-রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে আরবরা অতর্কিতভাবে পার্শ্ববর্তী পৃথিবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা প্রথম যে বিজয় লাভ করে, কারও কারও মতে সে ছিল আরব জাতির বিজয় ইসলামের বিজয় নয়। ইসলামের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর আগে সিরিয়া, মেসোপটেমীয়া ও পারস্যের অধিকাংশ বাসিন্দাই ইসলাম গ্রহণ করে নাই। এসব রাজ্যের সামরিক বিজয়ের অনেককাল পর বাসিন্দারা মুহম্মদের (সঃ) ধর্ম অবলম্বন করে। আর যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করল, তখন তারা ইসলাম ধর্মের মায়ায় যতখানি আকৃষ্ট হল, তার চেয়ে অনেক বেশি আকৃষ্ট হল জিজীয়ার হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করে শাসক শ্রেণীর গণ্ডীভূত হওয়ার জন্য। তারপর আসছে, তমদ্দুন হিসেবে ইসলামের কথা। সামরিক বিজয়ের পর ধীরে ধীরে ইসলামী তমদ্দুনের উদ্ভব হয় এবং ইসলামের পূর্বগামী সিরীয়-আরমেনীয়, পারসিক ও গ্রীক তমদ্দুনের আংশিক ভিত্তির উপর এ নব তমদ্দুন গড়ে ওঠে। ইসলামের সাহায্যে নিকট-প্রাচ্য কেবল যে তার হৃত-রাজনৈতিক শাসনাধিকার ফিরে পেল এমন নয়, তমদ্দুনের ক্ষেত্রেও তার সুমহান প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠা পুনঃস্থাপন করল।
কিন্তু বাইরের দেশ জয় করার আগে আরবের নিজস্ব সংহতির প্রয়োজন। ছিল। এই ঐক্য-বিধানের পথের সন্ধানকালে উত্থাপিত হল মহানবীর উত্তরাধিকার অর্থাৎ খিলাফত সমস্যা।