আরব জাতির ইতিহাস-এর প্রেক্ষাপট উন্মোচিত হয়েছে আরব উপদ্বীপের কোলে লালিত ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, কালদীয়, আর্মেনীয় এবং ফিনিশীয় জাতিনিচয়ের ইতিহাস ঐতিহ্য কালের করাল গ্রাসে বিলিন হওয়ার বয়ান দিয়ে। এরা সবাই এক কালে ছিল আজ আর নাই। আরবেরা ছিল আজো তারা আছে। আরব জাতি, মুসলিম ও সিমাইট–জাতি সম্প্রদায় আর তাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে গভীর বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে। আদিম আরব বেদুইনদের জাত্যাভিমান, তাদের অন্তর্লীন ভাবনা ও জীব বৈশিষ্ট্যকে কাব্যিক ভাবধারায় তুলে আনা হয়েছে। রাসূল (দঃ)-এর অধ্যায়টি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্বলিত বিচার বিশ্লেষণে নির্মোহ দৃষ্টিতে রাহমাতুল্লিল আলামিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানব জাতির ত্রাতা হিসেবে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা উঠে এসেছে। কিতাব ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক অনুসন্ধানে হিট্টি সংশ্লিষ্ট গোত্র বা সম্প্রদায়ের জীবনাচার ও সংস্কৃতির সাযুজ্য সাধনে আসমানী কিতাবসমূহের অবিসংবাদিত ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন। অভিযান পথে ইসলাম শীর্ষক অধ্যায়ে হিট্রি তুলে ধরেছেন কিভাবে অসি নয় মশির জোরে, সাম্য ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ সূত্রে ইসলাম সাম্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারিত হয়েছিল। মুসলিম শাসনে খেলাফতের বৈশিষ্ট্য এবং ক্রমাবনতি ও পুনরুত্থানের পথ পরিক্রমা নির্দেশ করা হয়েছে খেলাফত অধ্যায়ে। মুসলমানদের স্পেন বিজয়কে ইসলামের ইতিহাসের অতি গৌরবময় অধ্যায় বলে সনাক্ত করেছেন হিট্টি। কেননা স্পেন বিজয়ের মাধ্যমেই ইউরোপে ইসলামের ঝাণ্ডা ওড়ে, ইসলামের সুশীতল ছায়ায় ইউরোপের অবগাহনের অভিষেক ঘটে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে সামাজিক ও তামনিক জীবনের আরম্ভ, গৌরব যুগে বাগদাদ, জাতির জীবন, সাহিত্য ও বিজ্ঞান, চারু শিল্প প্রভৃতিতে ইসলামের অবদানকে হাই লাইট করা হয়েছে। জগতমনি কর্ডোভাকে বিশ্ব সভ্যতা বিকাশে ইসলামের অনন্য অবদানের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে হিট্টি পাশ্চাত্য জগতে আরবের অবদানের সালতামামী কষেছেন। এর পরে ক্রুসেড সংক্রান্ত পর পর দুটি লেখায় বিশ্লেষণে প্রয়াস পেয়েছেন কিভাবে ইসলামের গৌরব প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর অনৈক্যের অতলে তলিয়ে গিয়েছে। শেষ শাসক বংশ আর বর্তমানের আধুনিক আরব বিশ্ব শীর্ষক দুটি অধ্যায়ে ক্ষয়িষ্ণু শাসন আমল আর মুসলিম বিশ্বের হাল হকিকত তুলে ধরে হিট্টি এই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন যে, আধুনিক শিক্ষা প্রযুক্তি ব্যবহার আর নিস্বার্থবোধ ও অয়োময় প্রত্যয়দীপ্ত ঐক্য চেতনা আরব তথা মুসলিম দেশ ও জাতির সার্বিক ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম উপায়।
হিট্টির ইতিহাস অনেকটা কাব্যিক ও প্রত্নতাত্তিক ভাষায় লিখিত। ইবরাহীম খাঁ অনুবাদে সে মেজাজ অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। আবার এ দেশীয় স্বল্প শিক্ষিত মুসলমান পাঠকের বোধগম্যকরণের দিকেও ছিল তাঁর সচেতন দৃষ্টি । ফলে এটি একটি অনবদ্য অনুবাদে পরিণত হয়। ১৯৫৯ সালে প্রথম প্রকাশের পর সমকালীন পত্র পত্রিকায় এই অনুবাদ কর্মটির বিশেষ প্রশংসাসূচক মূল্যায়ন প্রকাশিত হয় এবং এর বিভিন্ন অধ্যায় মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়। উচ্চতর পর্যায়ে এটি সহায়ক পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যেহেতু এটি মূল History of the Arabs এর অনুবাদ ছিল না, এটি ছিল একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণের সরল অথচ ভাবানুবাদ প্রকৃতির সেহেতু ইবরাহীম খাঁ ‘আরব জাতির ইতিকথা’ শিরোনাম ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন প্রতীয়মান হয়। তখনকার সময় সাধারণ পাঠক সমাজে ইতিহাসের চেয়ে ইতিকথার সমাদর ছিল যেন বেশী। ইতিহাস পাঠ ও পঠন সে যুগে তখনো ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি যতটা হয়েছে ইদানিংকালে। সেকালে পাঠক ইতিকথাকে কৌতূহল উদ্দীপক বিষয় মানত, ইতিহাসের ভারিক্কির মধ্যে মাথা ঢোকানোটা সহজ ও জনপ্রিয় কাজ মনে করত না। পুনর্মুদ্রণ কালে প্রকাশক মোহাম্মদ সহিদুল ইসলাম তাঁর জ্ঞান বিতরণী’ মিশনের অংশ হিসেবে, যুগের রুচি ও বোধ-বুদ্ধির বিকাশ বিবেচনায় এনে ইতিকথায় ইতি টেনে ‘ইতিহাস’করণের যে আইডিয়া মাথায় এনেছেন তা আমার কাছে অসঙ্গত মনে হয়নি। তবে অনুবাদকের অনুমতি নিতে পারলে বেহেতর হত। ইবরাহীম খাঁ ছিলেন দরাজদিল ব্যক্তি, ষাড়ে সোলআনা শিক্ষাবিদ, রসে টইটম্বুর লেখক এবং অনুপম অনুবাদক। আমার বিশ্বাস তিনি দ্বিমত করতেন না; কিন্তু সেই ইবরাহীম খাঁ সাহেবকে পাই কোথায়? তিনি তো আমাদের সকল ধরা ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। মূল লেখক স্যার ফিলিপ কে হিট্টি আর অনুবাদক ইব্রাহিম খাঁ তারা উভয়ে ১৯৭৮ সালে পরপারে পাড়ি জমান। আমরা তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
২৫ জুন, ২০০৯
বাংলো ৪৩, মিন্টু রোড, ঢাকা
.
বাংলা সংস্করণ সম্পর্কে
এ বইয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আরবী ভাষা-ভাষী মানুষদের কাহিনী ও তাদের মহান সংস্কৃতির গৌরবময় অবদানের বিবরণ দেয়া হয়েছে। আরবদের বিচিত্র জীবনালেখ্য ও তাদের বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আজ আমাদের সামনে ইতিহাসের একটি মহিমোজ্জ্বল ও দিক-নির্দেশক যুগ-পরিক্রমার তোরণ-দ্বার খুলে দিয়েছে। লেখকের ‘হিট্টি অব্ দি এ্যারাস’ নামক বৃহদায়তনের বই হতে এ বইয়ের তথ্যাবলী সংযোজিত হয়েছে। প্রথমে গ্রন্থ-প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ম্যাকমিলান লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক হ’তে মূল বইটি প্রকাশ করেন। সংক্ষিপ্ত আকারের বইটি (দি এ্যারাবৃসঃ এ শর্ট হিস্ট্রি’) প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় হতে বের হওয়ার পর বহু সংস্করণে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর বহু ইউরোপীয় ও এশীয় ভাষায় এর অনেকগুলো অনূদিত সংস্করণ বেরিয়েছে। এ ভাষাগুলোর মধ্যে ফরাসী, স্পেনিশ, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, আরবী, উর্দু ও ইন্দোনেশীয় ভাষা উল্লেখযোগ্য।