পাপের কাফফারা হিসেবে উপবাসের উল্লেখ কোরআনে অনেক বার আছে। উপবাস হিসেবে রমযানের উল্লেখ আছে মাত্র একবার। রমযান মাসে উষাকাল হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পান ও আহার নিষিদ্ধ। রমযানের রোজা ভঙ্গ করার জন্য রাষ্ট্র বা জনসাধারণের পক্ষ হতে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এমন নজীরের অভাব নাই। আইয়ামে জাহেলীয়াতে উপবাস করার প্রথা ছিল, এমন কোন প্রমাণ আমরা পাই না। তবে উপবাস প্রথা খৃস্টান ও ইহুদী উভয় ধর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।
হজ্ব ইসলামের পঞ্চম এবং সর্বশেষ রোকন। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে প্রত্যেক সঙ্গতি-সম্পন্ন মুসলমানের পক্ষে জীবনে একবার মক্কায় হজে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য। হজের নির্দিষ্ট সময়ের আগে হজযাত্রী সেলাইহীন কাপড় পরে এহরাম বাঁধে। এহ্রামের সময় পবিত্র সময়। রমযানের সময় মুসলমানকে যে সব কাজ পরহেজ করে চলতে হয়, এহরামের সময় তাছাড়া আরো কয়েকটি পরহেজ করতে হয়–যেমন, রক্তপাত না করা, শিকার না করা, গাছ তুলে না ফেলা এবং স্ত্রী সহবাস না করা। পবিত্র স্থানে তীর্থ করতে যাওয়ার প্রথা বহু প্রাচীনকাল হতে সেমিটিক জাতিসমূহের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ওল্ড টেস্টামেন্টের যুগ পর্যন্ত আমরা তার নজীর পাই। মূলে এর উদ্ভব হয়েছিল হয়তো সূর্য-পূজার পদ্ধতি হতে। শরঙ্কালে যখন দিন রাত সমান হত, সেই সময় এ পূজার অনুষ্ঠান হত? অগ্নিময় সূর্যের কঠোর শাসনের এ ছিল বিদায় উৎসব, আর উর্বরতার বজ্রদেবতার ছিল এ আগমনী সম্বর্ধনা।
সেনেগাল, লাইবিরীয়া, নাইজিরীয়া হতে দলের পর দল হজ্বযাত্রী মধ্য আফ্রিকার বিভিন্ন পথে পূর্বদিকে চলেছে। যতই তারা এগিয়ে চলছে, ততই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে চলেছে হেঁটে, কেউ কেউ চলেছে উটের পিঠে। এদের বেশির ভাগই পুরুষ; কিছুসংখ্যক নারী এবং শিশুও সঙ্গে অছে। পথে পথে তারা বেচা-কিনি করে; ভিখ মাগে; অনেকে পথের ধারে পড়ে মরে–এরী শহীদের দরজা পায়। যারা বেঁচে থাকে, তারা অবশেষে লোহিত সাগরের কোন বন্দরে এসে হাজির হয়। সেখান হতে পার হয়ে এপারে আসে। কিন্তু প্রধান চারটি কাফেলা আসে–ইয়ামন, ইরাক, সিরিয়া ও মিসর হতে। এ চারটি দেশের প্রত্যেক দেশ আগে কাবা ঘরের গেলাফের জন্য মামিল-শরীফ পাঠাত। এ মামিল ছিল এসব দেশের ইজ্জতের পরিচায়ক। অত্যন্ত সুন্দররূপে সজ্জিত হাওদার ভিতর রেখে উটের পিঠে করে মামিল আনা হত। এ উটের পিঠে কেউ চড়ত না–উটকে লাগাম ধরে টেনে আনত। কিছুকাল হতে কেবল মিসর দেশই আগের মত ধুমধামে মামিল পাঠিয়ে আসছে।
গত দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়ে হজযাত্রীর সংখ্যা গড়ে ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার। ১৯০৭ সালের তুর্কী সরকারী কাগজে হজযাত্রীর সংখ্যা পাওয়া যায় ২ লাখ ৮০ হাজার। ১৯৫৫ সালে সউদী সরকারের কাগজে এদের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার। মালয় হতেই সাধারণতঃ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যাত্রী আসে। এদের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। যুগ যুগান্তর হতে এই হজ্ব প্রতিষ্ঠান মুসলিম-জগতের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের সবচেয়ে বড় শক্তিরূপে কাজ করে আসছে। বিভিন্ন শ্রেণীর বিশ্বাসীর মধ্যে এই-ই সাধারণ ঐক্যসূত্র। এই প্রতিষ্ঠান প্রায় প্রত্যেক সুস্থ-দেহ সঙ্গতি-সম্পন্ন মুসলমানকে জীবনে অন্ততঃ একবার দেশ ভ্রমণ করতে বাধ্য করে। পৃথিবীর চার দিক হতে আগত এই হজ্ব-যাত্রীদের সমাবেশ হতে যে সামাজিকতার উন্মেষ হয়, তার মূল্য বিপুল। নিগ্রো, বার্বার, চীনা, পারসিক, সিরিয়ান, তুর্ক, আরব –ছোট-বড়, ধনী-গরীব-ধর্মের এই উদার ময়দানে একত্র হয়, কথা-বার্তা বলে, ভ্রাতৃত্বের অনুশীলন করে। সমস্ত বিশ্ব-ধর্মের মধ্যে গোষ্ঠী, বর্ণ ও জাতির বিভেদ বাধা ভাঙ্গতে ইসলামই সবচেয়ে বেশি সফলতা লাভ করেছে বলে মনে হয়–অন্ততঃ এর নিজ সমাজের সীমার মধ্যে। বিভেদ রেখা টানা হয়, কেবল মুসলমান ও বাকী বিশ্ববাসীর মধ্যে। হজের এই সব জামাত এ উদ্দেশ্য সাধনে নিঃসন্দেহরকমে সাহায্য করেছে। যেসব দেশে যাতায়াতের আধুনিক পথ-ঘাট কিছুই নাই, সংবাদপত্রের প্রভাব যেখানে এখনো অত্যন্ত অল্প, সে-সব দেশের লোকও হজে আসে। হজের এই সুযোগে তাদের মধ্যে মাজহাবী মতবাদ প্রচারের যথেষ্ট সুযোগ ঘটে।
মুসলমানদের মধ্যে অন্ততঃ একটি সম্প্রদায়–খারেজীরা–জেহাদকে ইসলামের ষষ্ঠ রোকনের মর্যাদা দান করেছে। দারুল ইসলাম হতে দারুল হরবের সীমা রেখাকে দূর হতে দূরতর স্থানে সরিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকা খলীফার অন্যতম প্রধান কর্তব্য। কিছুকাল হতে মুসলিম-জগতে জেহাদী জোশ কমে গেছে। ইদানীং কোন কোন অমুসলমান শাসনে ইসলাম যথেষ্ট উন্নতি করেছে-হয় অত্যন্ত প্রবল বলে সে অমুসলমান-শক্তির উৎখাত করা সম্ভব হয় নাই, অথবা সে শক্তি অত্যন্ত উদার বলে তার উৎখাতের চেষ্টা সঙ্গত মনে করা হয় নাই। শেষ জেহাদ ঘোষণা করেন–১৯১৪ সালে–তুর্ক সুলতান খলীফা মুহম্মদ রাশাদ। কিন্তু তার সে আহ্বানে কেউ সাড়া দেয় নাই। একজন প্রাচ্যবিদ্যাবিদ গ্রন্থকার এই উপলক্ষে জার্মানীতে জেহাদ’ নামে একখানা বইও লেখেন।
জীবনে সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ সম্বন্ধে তদীরের বিশ্বাস (৯ : ৫১; ৩ : ১৩৯; ৩৫ : ২) ইসলাম সম্পর্কে অন্যতম বড় কথা। এই বিশ্বাস যুগে যুগে মুসলমানের চিন্তা ও ব্যবহারে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে এসেছে। এ জীবনে ভাল মন্দ যা কিছু ঘটে, সবই সম্পূর্ণ রমে আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে এবং তা আগে হতেই অনিবার্য-রূপে নির্দিষ্ট হয়ে আছ। তীরে বিশ্বাস ইসলামের এক বড় শক্তি। এই বিশ্বাসই আবার ইসলামের দুর্বলতার এক বড় কারণ।