পাপ দুই রকমের হতে পারে–নৈতিক ও আনুষ্ঠানিক। সব চেয়ে খারাপ এবং অমার্জনীয় পাপ হচ্ছে শির্ক-কাউকে আল্লাহ্র শরীক বানানো। আল্লাহ্ এক নয়, বহু–এমন মতবাদকে হযরত মুহম্মদ (সঃ) সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন। মদনী সূরাগুলির মধ্যে একাদিক্রমে মুশরিক বা বহু-ঈশ্বরবাদীদের শেষ বিচারের ভয় দেখানো হয়েছে। মনে হয়, হযরত মুহম্মদ (সঃ) কিতাবী লোকদের অর্থাৎ খৃস্টান ও ইহুদীদের মুশরিক মনে করতেন না; যদিও মুফাসসির বা ভাষ্যকারদের মধ্যে কেউ কেউ অন্য রকম মত পোষণ করে থাকেন।
কোরআনের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী অংশে আলোচিত হচ্ছে ভবিষৎ জীবনের কথা। বিচারের দিন’–’পুনরুত্থানের দিন’-মহাদিন’-মহাক্ষণ’–সেই অনিবার্য প্রভৃতি কথা মারফত ভবিষ্যৎ জীবনের বাস্তবতার উপর বার বার জোর দেওয়া হয়েছে। কোরআনে ভবিষ্যৎ জীবন যেভাবে চিত্রিত হয়েছে–এর দৈহিক যাতনা, এর শারীরিক ভোগ–তাতে দেহের পুনরুত্থানেরই ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে হয়।
মুসলমানের ইবাদাঁতের কাজ বা তার ধর্মীয় কর্তব্যের কেন্দ্র হচ্ছে ইসলামের পঞ্চ-স্তম্ভ বা পাঁচ রোকন।
ইসলামের প্রথম রোকন হচ্ছে, বিশ্বাস ঘোষণা এবং এ বিশ্বাস ঘোষণার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, সেই মহান কলেমা : লা-ইলাহা ইল্লাহল্লাহ্ : মুহম্মদুর রসূলুল্লাহ্। মুসলমান পরিবারে নবজাত শিশুর কানে প্রথম যে কথা দেওয়া হয়, তা এই মহাযাত্রার পথেও এই শেষ কথাই তাকে শুনিয়ে দেওয়া হয়। আর, জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে এরমত আর কোন কথাই সে এমন ঘন ঘন উচ্চারণ করে না। মুয়াজ্জিন দিনে অনেকবার মিনারে দাঁড়িয়ে আজান দেয় এবং প্রত্যেক বারই সে এই কলেমা উচ্চারণ করে। এই কলেমার মৌখিক ঘোষণাতেই মুসলমানেরা সাধারণতঃ খুশী। কোন অমুসলমান এই কলেমা গ্রহণ ও ঘোষণা করলেই সে নামতঃ মুসলমান হয়ে যায়।
মুমিন মুসলমানকে দিনে পাঁচবার-উষা কালে, দ্বিপ্রহরে, মধ্য-অপরাহে, সূর্যাস্তে এবং রাত্রিতে কাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামায পড়তে হবে এই তার ধর্মের বিধান। নামায ইসলামের দ্বিতীয় রোকন। নামাযের ওয়াক্তে মুসলিম জগতের দিকে চাইলে দেখা যাবে, মক্কা হতে শুরু করে পৃথিবীর এক বিপুল এলাকায়–সিয়েরালিয়ে হতে ক্যান্টন এবং টোবলস্ হতে কেপটাউন পর্যন্ত মুসলমান ছোট বড় জামাতে নামায-রত আছে।
নামায মুসলমানের আনুষ্ঠানিক ধর্ম। একই নিয়মে, দেহ একই রকমে অবনত করে সবাইকে নামায আদায় করতে হয়। মুসুল্লীকে প্রথমে ওজু করতে হয় এবং তারপর তার মাতৃভাষা যাই হোক না কেন, আরবীর মাধ্যমে ইবাদাত করতে হয়। নামাযের যে বাঁধা-ধা গতানুগতিক রূপ, তাতে আল্লাহর দরবারে আবেদন যতখানি তার চেয়ে বেশি আল্লাহর নাম উচ্চারণ। ফাতিহা (প্রারম্ভিক সূরা) সহজ সরল কিন্তু অর্থ ও ভাব-গাম্ভীর্যে গরীয়ান একটি ছোট সূরা। মুমিন মুসলমান এ সূরাটি দিনে প্রায় বিশবার আবৃত্তি করে। রাত্রিতে যে নফল নামায পড়া হয়, তার সওয়াব দ্বিগুণ কারণ, তা স্বেচ্ছাকৃত অতিরিক্ত উপাসনা।
শুক্রবার দুপুরের নামায জামাতে পড়তে হয় এবং বালেগ সমস্ত পুরুষের জন্যই এনামায অবশ্য কর্তব্য। কোন কোন মসজিদে স্ত্রীলোকের জন্য আলাদা জায়গা থাকে। শুক্রবারের নামাযে একটা বৈশিষ্ট্য আছে –এ নামাযে ইমাম খোতবা (বক্তৃতা দেন এবং খোতবায় রাষ্ট্রের অধিপতির মঙ্গলের জন্য দোওয়া করা হয়। এই নামাযের জামাতের সঙ্গে ইহুদীদের মন্দিরের উপাসনার মিল আছে। খৃষ্টানদের রবিবারের উপাসনা-পদ্ধতি পরবর্তী যুগে মুসলমানদের শুক্রবারের নামায-পদ্ধতিকে খানিকটা প্রভাবিত করে। মর্যাদা, সরলতা ও শৃঙ্খলায় কোন রকম জামাতী উপাসনাই শুক্রবারের নামাযকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নাই। যখন মুসুল্লীরা মসজিদে আপনা-আপনি কাতারে কাতারে সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং পরম ভক্তির সঙ্গে একান্তভাবে ইমামের অনুসরণ করে, তখন সে দেখবার এক দৃশ্য হয়। মরুভূমির গর্বিত অত্ম-সচেতন সন্তানদের উপর জামাতের নামাযের এ নিয়মানুবর্তিতা নিঃসন্দেহ রকমে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল : জামাতের নামায তাদের শিখিয়েছিল সামাজিক সাম্য আর তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল এক মহান ঐক্যভাব। হযরত মুহম্মদ (সঃ) নীতি হিসেবে রক্তের সম্বন্ধের স্থানে মুসলিম-ভ্রাতৃত্বের সম্বন্ধকে স্থাপন করেছিলেন। জামাতী-নামায এই ভ্রাতৃ-ভাবকে কার্যতঃ পুষ্ট করেছে। নামাযের ময়দানই ইসলামের প্রথম ড্রিলের ময়দান।
জাকাত ইসলামের তৃতীয় রোকন। জাকাত প্রথমে ছিল ভালবাসামূলক স্বেচ্ছাকৃত মহাপুণ্যের কাজ। পরে ইহা টাকা, উট, দুম্বা, শস্য, ফল এবং সওদাগরী চীজ প্রভৃতি সম্পত্তির উপর অবশ্য-দেয় কর হিসেবে ধার্য হয়। ইসলামের তরুণ রাষ্ট্রে উপযুক্ত কর্মচারীরা নিয়মিতভাবে জাকাত আদায় করত। কেন্দ্রীয় খাজনা-খানায় জাকাতের টাকা জমা হত এবং সেখান হতে গরীবের সাহায্য, মসজিদ নির্মাণ এবং সরকার পরিচালন কাজে ব্যয়িত হত। প্রিনী বলেন ও দক্ষিণ আরবের সওদাগরগণকে বিক্রির আগে তাদের মশলার এক দশমাংশ তাদের দেবতাদের দিতে হত। জাকাতের মূলনীতি কতকটা ঐ রকম। জাকাতের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন ছিল; তবে সাধারণতঃ এর গড় ছিল শতকরা আড়াই। সৈন্যদের পেনশনও জাকাতের দায় হতে মুক্ত ছিল না। পরবর্তীকালে যখন খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার অবসান ঘটল, তখন জাকাত আদায় আবার মুসলমানদের বিবেকের উপর ছেড়ে দেওয়া হল। জাকাত ইসলামের চতুর্থ রোকন।