মদীনা হতে ইসলামের ধর্মরাজ্য প্রথমে সমগ্র আরবে এবং পরে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। মদীনার সমাজ ছিল পরবর্তী মুসলিম সমাজের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। এতকাল পর্যন্ত যে আরব দেশ ছিল মাত্র একটি ভৌগোলিক বাক্য, যে আরব-সমাজের লোকেরা কোন দিনই ঐক্যবদ্ধ হয় নাই, সেই আরব দেশে এবং সেই আরব-সমাজে হযরত মুহম্মদ (সঃ) তাঁর এক নম্বর জীবনে গড়ে তুললেন একটি জাতি প্রবর্তন করলেন এমন একটি ধর্ম যা খৃষ্টান, ইহুদী প্রত্যেক ধর্মের চেয়ে বেশি স্থান অধিকার করে আছে এবং দুনিয়ার মানুষের এক বিপুল অংশ যে ধর্ম মেনে চলে এবং এমন একটি সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করলেন যা অনতিবিলম্বে তৎকালীন সভ্যজগতের সুন্দরতম অঞ্চলগুলি অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। তিনি কখনো কোন বিদ্যালয়ে যান নাই; তবু তিনি এমন একটি গ্রন্থ রেখে গেলেন, যে গ্রন্থকে দুনিয়ার সাত ভাগের এক ভাগ মানুষ আজো সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বিজ্ঞান এবং সমস্ত ধর্ম-তত্ত্বের আধার বলে মনে করে।
০৫. কিতাব ও ধর্ম
কোন মুসলমান পথে এক টুা কাগজ পড়ে আছে দেখলে তা তখনি কুড়িয়ে নিয়ে পাশের দেয়ালের কোন গর্তে সযত্নে রেখে দেয়; কারণ, কি জানি ওতে যদি আল্লাহর নাম থেকে থাকে!––এ দৃশ্য আজো বিরল নয়। কোরআন আল্লাহর কিতাব ও মুসলমান এ কিতাবকে পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এ যে আল্লাহর কথা : জিব্রাইল হযরত মুহম্মদের (সঃ) কাছে বহন করে এনেছেন। যারা পাক-সাফ নয়, এমন কেউ যেন এ কিতাব না ছোঁয়’ (৫৬ : ৭৮)।
দুনিয়ায় খৃষ্টানদের সংখ্যা মুসলমানদের মোটামুটি দ্বিগুণ। তথাপি এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে যে, কোরআন যত লোক পড়ে, অত লোকে আর কোন কিতাবই পড়ে না। নামাযের সময় কোরআনের সূরা তো ব্যবহার করা হয়ই, তাছাড়া কোরআন পাঠ্যবই এবং এ বই হতে কার্যতঃ প্রত্যেক মুসলমানই আরবী পড়তে শিখে। তুর্কীতে কোরআনের একটি সরকারী অনুবাদ হয়েছে। তাছাড়া, আর কোন ভাষায় এর সরকার অনুমোদিত অনুবাদ হয় নাই। তবে বিনা অনুমোদনে প্রায় চল্লিশ ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছে। রডওয়েল-কর্তৃক অনুবাদ এভরীম্যানস্ লাইব্রেরীতে সহজেই পাওয়া যেতে পারে। কোরআনের প্রথম অনুবাদ হয় ল্যাটিন ভাষায়। কুনীর এবট মহামান্য পিটার দ্বাদশ শতাব্দীতে এর অনুবাদ শুরু করেন। তাঁর মতলব ছিল ইসলামের মতবাদকে খণ্ডন ও ইসলামের প্রবর্তককে হেয়প্রতিপন্ন করা। ১৬৪৯ সালে প্রথম ইংরেজী অনুবাদ দেখা দেয়।
বাইবেলের তুলনায় কোরআনে পাঠ-ঘটিত অনিশ্চয়তা নাই বল্লেই চলে। হযরত মুহম্মদের (সঃ) ইন্তেকালের (উনিশ বছর) পর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে কোরআনকে প্রথম, শেষ এবং একমাত্র অনুমোদিত গ্রন্থ আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়। কারণ, তখন নানাযুদ্ধ-বিগ্রহে কোরআনের হাফিজের সংখ্যা নিঃশেষ হয়ে আসছিল। এর আগে বে-সরকারীভাবে খেজুরের পাতা, সাদা পাথরের ফলক ও মানুষের বুক’ হতে একটি কোরআন সংগৃহীত হয়েছিল। অতঃপর অনুমোদিত সংস্করণ ছাড়া কোরআনের আর সব সগ্রহ নষ্ট করে ফেলা হল। এর ৬,২৩৯টি আয়ত, ৭৭,৯৩৪টি শব্দ, এমন কি এর ৩,২৩,৬২১টি হরফ যত্নের সঙ্গে গণে রাখা হয়েছে। অবশ্য সব হিসেবে সংখ্যা সর্বাংশে মিলে না। কোরআন কেবল একটি ধর্মের প্রাণ নয়, কেবল বেহেস্তের কুঞ্জী নয়–কোরআন বিজ্ঞান এবং রাজনৈতিক দলীলের সংক্ষিপ্ত সারও বটে। এ দুনিয়ার রাজ্য চালনার আইন-কানুনও এতে আছে। কোরআন এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের মধ্যে সাদৃশ্য বহু এবং বিস্ময়কর। কোরআনে যেসব ঐতিহাসিক কাহিনী আছে, তার প্রায় সবগুলিরই অনুরূপ কাহিনী বাইবেলে আছে। ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিতদের মধ্যে কোরআনে আছে আদম, নুহ, ইব্রাহীম (প্রায় ৭০ বার উল্লিখিত), ইসমাইল, লুত, ইউসুফ, মুসা (৩৪টি সুরায় এর নাম আছে), সল, সোলায়মান, দা, ইলিয়াস, আয়ুব এবং ইউনুস। সৃষ্টি ও আদমের পতনের কাহিনী পাঁচ বার বলা হয়েছে, মহাপ্লাবনের কথা বলা হয়েছে আটবার, সোডমের কথাও আটবার। নিউ টেস্টামেন্ট বর্ণিতদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছেন জাকারীয়া, জন-দি-ব্যাপটিস্ট, ইসা এবং মরীয়ম। হিব্রু ও আরবী ভাষার অনেক প্রবাদ-বাক্য ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট ও কোরআনে একইরকমভাবে পাওয়া যায়; যেমন-’চোখের বদলে চোখ’, বালির উপর তৈরী বাড়ী’, উট ও সূচের চোখ এবং প্রত্যেকের জন্য মউতের পেয়ালা।’কোরআনে ইসার শৈশবকালে কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা আরোপ করা হয়েছে যেমন–দোলনায় শুয়ে কথাবার্তা এবং কাদা দিয়ে পাখী তৈরী। প্রক্ষিপ্ত-অংশ যুক্ত(এপোক্রিফাল)গপেলে অনুরূপ কাহিনী পাওয়া যায়।
নিউ টেস্টামেন্টের খৃস্টান ধর্ম ওল্ড টেস্টামেন্টের ইহুদী ধর্মের যত কাছে, কোরআনের ধর্ম তার চেয়ে অনেক বেশী কাছে। তবে খৃস্টান ও ইহুদী উভয় ধর্মের সঙ্গে ইসলামের সাদৃশ্য এত বেশি যে, ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় একে স্বতন্ত্র ধর্ম মনে না করে কেউ কেউ নিশ্চয় একে খৃস্টান ধর্মেরই একটি বিরুদ্ধ মতবাদ বলে মনে করেছেন।
কোরআনে সূরাসমূহ তাদের দৈর্ঘ্য অনুসারে সাজানো হয়েছে। প্রথম দিকের সূরাগুলি (হিজরতের পূর্বের) সংখ্যায় প্রায় নব্বই এবং প্রাথমিক যুগের কৃচ্ছ সাধনার কালে অবতীর্ণ। এ সূরাগুলি প্রায়ই ছোট, তীক্ষ্ণ, জলন্ত, উত্তেজনাময় এবং পয়গম্বর-জনোচিত অনুভূতিতে পরিপূর্ণ। এসব সূরায় প্রধানতঃ বলা হয়েছে আল্লাহর একত্ব, তার গুণাবলী মানুষের নৈতিক কর্তব্য এবং আসন্ন শাস্তির কথা। মদনী সূরাগুলি সংখ্যায় চব্বিশ–কোরআনের প্রায় এক তৃতীয়ংশ–অবতীর্ণ হয়েছিল (হিজরতের পরে অবতীর্ণ) বিজয়ের যুগে। এগুলি প্রায়ই দীর্ঘ, বাগ বহুল, এবং আইনের মাল-মসলায় সমৃদ্ধ। এসব সূরায় ধর্মের আকিদা এবং জামাতে নামায, রোজা, হজ্ব এবং পবিত্র মাসসমূহ সম্পর্কিত বিধান বিবৃত হয়েছে। এতে আছে : মদ, শুকরমাংস ও জুয়া খেলার নিষেধমূলক আইন, জাকাত, ও জেহাদ সম্পর্কিত অর্থনৈতিক ও সামরিক আইন : হত্যা, প্রতিশোেধ, চুরি, সুদ, বিয়ে, তালাক, ব্যভিচার, ওয়ারিসী-স্বত্ব এবং গোলাম-আযাদ বিষয়ক দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন। ইসলাম সম্পর্কে বহু বিবাহের কথা অনেক সময় উল্লেখ করা হয়; কিন্তু ইসলামের বহু বিবাহ-ঘটিত আইন বহু বিবাহের প্রবর্তন করে নাই–বহু বিবাহকে সীমাবদ্ধ করেছে। অমুসলমান সমালোচকদের মতে তালাক সম্পর্কিত বিধানগুলি (৪ : ২৪, ৩৩ : ৪৮, ২ : ২২৯) সবচেয়ে আপত্তিজনক এবং গোলাম, এতিম ও মুসাফিরের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কিত বিধানগুলি সবচেয়ে উদার। গোলাম-আযাদ করাকে এই বলে উৎসাহ দেওয়া হয় যে, এ কাজে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং এতে বহু পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়।