এই ৯ম হিজরীকে বলা হয় প্রতিনিধিদলের বছর। এই বছর নিকট ও দূরের বহু প্রতিনিধিদল শাসক পয়গাম্বরের নিকট আনুগত্য স্বীকার করতে আসে। কওমের পর কওম মহানবীর সঙ্গে যোগ দেয়–ধর্ম বিশ্বাসের জন্য না হলেও অন্ততঃ সুযোগ সুবিধার জন্য। সামান্য খাজনা ও ইসলামের প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি আদায় করেই মুসলিম কর্তৃপক্ষ তুষ্ট ছিলেন। ইয়ামন, হাদ্রামাউত ও ওমানের মত দূরবর্তী স্থান হতেও দলে দলে লোক এসে হাজির হয়। যারা কোনদিনই কোন একজন মানুষের প্রভুত্ব স্বীকার করে নাই, আরবের সেই সব সম্ভ্রান্ত কওম ও শেখ হযরত মুহম্মদের (সঃ) কর্তৃত্ব মেনে নিতে এবং তার পরিকল্পনায় শরীক হতে রাজী হল। এক মহত্ত্বর ধর্ম ও উন্নততর নীতির নিকট প্রতিমা পূজা নতি স্বীকার করতে লাগল।
হিজরী দশম অব্দে মহাসমারোহের সঙ্গে হযরত মুহম্মদ (সঃ) তাঁর নতুন ধর্মীয় রাজধানী মক্কায় হজ করতে গেলেন। মক্কায় এই-ই ছিল তাঁর শেষ গমন; এবং একেই বলা হয় হজ্জতুল বেদা’–বিদায় হজ্ব মক্কা হতে ফিরে আসার তিনমাস পর ৬৩২ সালের ৮ জুন মহানবী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ইন্তিকাল করেন (ইন্নালিল্লাহ্…)।
মহানবীর মদীনার জীবন-কালে অনেকগুলি দীর্ঘ ওহী নাজেল হয়। এসব বাণীতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত প্রভৃতি ধর্মীয় বিষয়ের আলোচনা ছাড়াও বিয়ে-তালাক, গোলাম-বাঁদী, যুদ্ধ-বন্দী ও শক্রর সঙ্গে ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ক অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন সম্বন্ধে কথা আছে। মহানবী নিজে শৈশবে এতিম ছিলেন। গোলাম, এতিম, দুর্বল ও মযলুমদের সম্বন্ধে তিনি যে আইন করেছেন, তা নিতান্ত উদার।
হজরত মুহম্মদকে (সঃ) কেউ যখন জানত না, তখন তিনি যেমন অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন, আর গৌরবের শিখরে অবস্থানকালেও তিনি তেমনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। আজও আরব ও সিরিয়ায় যেমন ছোট ছোট কাদার ঘর আছে, মহানবী তেমনি একটি কাদার ঘরে বাস করতেন। সে ঘরে মাত্র কয়েকটি কোঠা ছিল; ঘরের সামনে ছিল একটি আঙ্গিনা। এই আঙ্গিনা পার হয়ে ঘরে যেতে হত। অনেক সময় তাকে তার নিজ ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে দেখা যেত এবং যে কোন সময় যে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারত। হোগাৰ্থ বলেন : তার ছোট বড় সমস্ত দৈনন্দিন ব্যবহারই এক রকম আইনে পরিণত হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ লোক জেনে শুনে তার অনুকরণ করে থাকে। যাঁদের কেউ কেউ ‘পূর্ণ মানুষ বলে বিশ্বাস করে, তাদের কারো ব্যবহারই এমন ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয় নাই।
তাঁর যে সামান্য সম্পত্তি ছিল, তাকে তিনি রাষ্ট্রের সম্পত্তি বলে মনে করতেন। তিনি প্রায় বারোটি বিয়ে করেন–কোন কোন বিয়ে ভালোবাসার জন্যে, আর কোন কোন বিয়ে রাজনৈতিক কারণে। তাঁদের মধ্যে তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিলেন আবুবকরের কন্যা তরুণী আয়েশা। খাদীজার গর্ভে তার কয়েকটি সন্তান জন্মে ছিল; কিন্তু এক ফাতিমা ছাড়া তাঁর জীবদ্দশাতেই বাকী সকলের মৃত্যু হয়। এই ফাতিমাই আলীর বিখ্যাত সধর্মিনী ছিলেন। হযরত মুহম্মদ (সঃ) মরিয়ম নামী কিপ্তী-খৃস্টান স্ত্রীর গর্ভে ইব্রাহিম নামে একটি ছেলের জন্ম হয় এবং শৈশবেই তার পরলোক গমন ঘটে। হযরত মুহম্মদ (সঃ) এ’ পুত্রের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করেন।
মদীনার ধর্ম-সমাজ হতেই পরবর্তীকালে মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। মুহাজির ও আনসারের এই মিলিত সমাজ ধর্মের বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে আল্লাহ্র জামাত বলে গণ্য হয়। আরবের ইতিহাসে রক্তের বুনিয়াদের উপর না করে ধর্মের বুনিয়াদের উপর সমাজ গঠনের চেষ্টা এই-ই প্রথম। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হচ্ছে আল্লাহ্র মহান শক্তির মূর্তিমান বিকাশ। মহানবী যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তিনি আল্লাহর খলীফা এবং দুনিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনকর্তা ছিলেন। সুতরাং হযরত মুহম্মদ (সঃ) তাঁর ধর্ম-ঘটিত কর্তব্য ছাড়াও দুনিয়ার যে কোন রাজা-বাদশাহ্র মত রাষ্ট্রের কাজ করতেন। এই সমাজের সকল মানুষ তাদের কওম ও পূর্ব আনুগত্য নির্বিশেষে এখন পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেল । (অন্তত নীতিগতভাবে)। বিদায় হজে রসূলুল্লাহ্ যে মহান খোত দিলেন, নিম্ন কথাগুলি তারই অংশ।
‘হে জনমণ্ডলি! আমার কথা মন দিয়ে শোন এবং তা হৃদয়ে গেঁথে নাও। জেনে রাখ, প্রত্যেক মুসলমান অন্য প্রত্যেক মুসলমানের ভাই ও এখন তোমরা সকলে মিলে এক ভ্রাতৃসংঘ। যদি ইচ্ছা করে না দেয়, তবে তোমাদের এক ভাইয়ের কোন চীজ অন্য ভাইয়ের আত্মসাৎ করা বৈধ নয়।’
এতকাল পর্যন্ত আরব সমাজের বুনিয়াদ ছিল কওমী জ্ঞাতিত্ব। হযরত মুহম্মদ (সঃ) এমনিভাবে এক আঘাতে তার পরিবর্তন করে ধর্মের বন্ধনকে করলেন নব সমাজের বুনিয়াদ। হযরত মুহম্মদের (সঃ) মৌলিকতার এ একটি প্রধান দাবী। নতুন সমাজে কোন পাদ্রী পুরুহিতের স্থান রইল না। এর মসজিদ হল জনসভার স্থান, সামরিক ড্রিলের ময়দান, এবং জামাতবদ্ধ নামাজের জায়গা। নামাজের ইমাম হলেন ময়দানে সেই মুমিনদের সেনাপতি যারা সমস্ত দুনিয়ার বিরুদ্ধে পরস্পর আত্মরক্ষার জন্য আদিষ্ট। আরবে এর পরেও যারা পৌত্তলিক রয়ে গেল, তারা রইল এ সমাজের বাইরে প্রায় যেন আইনের রক্ষণেরও বাইরে। ইসলাম সমস্ত অতীতকে নাকচ করে দিল। আরবের নিকট নারীর পরই প্রিয় ছিল মদ আর জুয়া। এক আয়াত এসব বন্ধ করেছিল। প্রায় অনুরূপ আকর্ষণের বস্তু ছিল সঙ্গীত : তার উপরও বিরূপ কটাক্ষ হানা হল।