এখন আমরা আরব-উপদ্বীপের প্রাচীন ইতিহাসের আর একটি ঘটনার কথা বলব। এ ঘটনা অমন চমকপ্রদ নয়; কিন্তু এর ফল ছিল গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। খৃষ্টপূর্ব ১২২৫ অব্দে মিসর হতে ফিলিস্তিন যাওয়ার পথে হিব্রু কওমেরা সিনাই এবং নুফুদে চল্লিশ বছরকাল অবস্থান করে। সিনাইয়ের দক্ষিণ অংশের নাম মিদিয়ান। এই মিদিয়ানে স্বর্গীয় চুক্তি (কওভনেন্ট) সম্পাদিত হয়। এই কওমদের নেতা ছিলেন হযরত মূসা (আঃ)। মূসা এখানে একটি আরব রমণীকে বিবাহ করেন। কনে একজন মিদিয়ানী পুরুহিতের কন্যা ছিলেন (একসোডাস ৩ : ১; ১৮ : ১০-১২)। এই বিবাহ হতে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনার সূচনা হয়। মূসার বিবি ইয়াহু নামক একটি দেবতার পূজা করতেন। এই ইয়াহুই পরে জেহোভা নামে অভিহিত হয়। ইয়াহু মরুর দেবতা ও অনাড়ম্বর, কঠোর। তার অধিষ্ঠান-স্থান ছিল একটি তাঁবু। আচার-অনুষ্ঠান ছিল সংক্ষিপ্ত : মরুর খানাপিনা, বলি এবং পোড়া নৈবেদ্য। মিদিয়ানী পুরুহিতের কন্যা মূসাকে এই ধর্মে শিক্ষা দিলেন। কি বিরাট ঘটনাবলীই না এর থেকেই উদগত হল।
মরুভূমিতেই যে হিব্রুদের উৎপত্তি, ওল্ড টেস্টামেন্টে তার অনেক পরিচয় আছে। পয়গম্বর জেরেমিয়ার উল্লিখিত রাজারা খুব সম্ভব উত্তর-আরব ও সিরীয় মরুভূমির শেখ ছিলেন। সোলায়মানের সঙ্গীত বলে যা কথিত হয়, তার বর্ণনায় শুনামাই সুন্দরীর রূপ অমর হয়ে আছে। শুনামাইত সম্ভবতঃ কেদার কওমের এক আরব ললনা ছিলেন। প্রাচীন সেমিটিক জগতের কবিতার মধ্যে আয়ুবের রচিত কবিতা সব চেয়ে সুন্দর। এ আয়ুব ইহুদী ছিলেন না, আরব ছিলেন। যে পূর্বদেশ আগত জ্ঞানী ব্যক্তিরা তারার গতি অনুসরণ করে জেরুজালেম এসে হাজির হয়েছিলেন, মনে হয় তারা ইরানের ম্যাগী ছিলেন না, উত্তর-আরবের মরুভূমিবাসী বেদুঈন ছিলেন। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে ইহুদীরা আরবদের নিকটতম প্রতিবেশী ছিল; জ্ঞাতিত্বের দিক দিয়েও তারা একান্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। বাইবেলের সঙ্গে এমনি সম্পর্কের তালিকা অনির্দিষ্টভাবে বাড়িয়ে যাওয়া চলে।
কিন্তু ইসলামের অভ্যুত্থান নিয়েই আমাদের আসল কথা। ইসলাম আল্লাহর ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণের ধর্ম। এখানে এই বল্লেই যথেষ্ট হবে যে, দক্ষিণ আরবে সেকালে যে জাতীয় জীবনের বিকাশ ঘটেছিল, খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে তা খান-খান হয়ে ভেঙ্গে পড়েছিল; রাজ্য জুড়ে চলছিল অন্তহীন অরাজকতা। বহুকাল হতে আরবে মূর্তি-পূজা প্রচলিত ছিল। বেদুঈনেরা প্রধানতঃ একটি চন্দ্র-দেবতাকে কেন্দ্র করে তাদের পূজা-অর্চনা করত। আর তাদের মত গরম দেশের পশু-পালকদের পক্ষে এই-ই স্বাভাকি ছিল বলে মনে হয়; কারণ, রাতের স্নিগ্ধতা তাদের কাছে প্রতিভাত হত বন্ধুরূপে, আর দিনের সূর্য প্রতিভাত হত শত্রুরূপে। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন এই মূর্তি পূজা হয়ে পড়ে, ছিল সেকেলে; মানুষের আধ্যাত্মিক-তৃষা আর এ ধর্ম দ্বারা পরিতৃপ্ত হচ্ছিল না। দেশে কতকগুলি অস্পষ্ট একেশ্বরবাদমূলক ধারণা আগেই আবির্ভূত হয়ে ধর্মরূপে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। দক্ষিণ-আরব ও নাজরানে খৃস্টান ও ইহুদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইয়ারিব (পরে মদীনা) অঞ্চলে ইহুদী কওমেরা বেশ উন্নত ছিল। সিরিয়া ও আবিসিনীয়া হতে মক্কার বাজারে খৃস্টান ব্যবসায়ী ও গোলাম আসত। খৃষ্টানদের প্রভাব ক্রমেই বেড়ে চলছিল; যদিও খৃস্টান ধর্ম-মত আরবদের চিত্তকে কখনো আকর্ষণ করতে পারে নাই। কিন্তু মঞ্চ তৈয়ার হয়ে গিয়েছিল এবং একটি মহান ধর্মীয় ও জাতীয় নেতার আবির্ভাবের সময় এসে পড়েছিল।
হযরত মুহম্মদের (সঃ) আবির্ভাবের আগের যুগকে মুসলমানেরা বলে জাহেলীয়ার যুগ। জাহেলীয়া-যুগের মানে অজ্ঞতা বা বর্বরতার যুগ। মহানবীর আবির্ভাবের প্রায় আগ পর্যন্ত উত্তর-আরবে যদিও কোন লিখন প্রণালী বিকাশ লাভ করে নাই, তথাপি দক্ষিণ-আরবে যে সমাজ গড়ে উঠেছিল তাকেও বর্বরতার যুগের অন্তর্ভুক্ত করা হলে অবিচার করা হয়। জাহেলীয়ার যুগে আরবে কোন প্রবর্তিত ধর্মের প্রভাব ছিল না–কোন প্রবুদ্ধ পয়গম্বর ছিলেন না।
দুনিয়ার আর কোন জাতিই আরবদের মত সাহিত্যিক-ভাষার এত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে না–আর কোন জাতি তাদের মত লিখিত বা কথিত কথা দ্বারা এত অভিভূত হয় না। আরবী ভাষার মত কোন ভাষাই বোধহয় সে ভাষাভাষীর মনের উপর এমন বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। হয়তো একটি কবিতার মর্মকথা তারা স্পষ্টভাবে বোঝেই না, হয়তো মার্জিত ভাষায় রচিত একটি বক্তৃতার অনেক কথাই তাদের বোধগম্য নয় তথাপি সেই বক্তৃতা বা সেই কবিতা আবৃত্তি করে আজও বাগদাদ, দামেস্ক এবং কায়রোর শ্ৰোতৃমণ্ডলীকে উত্তেজিত করে তোলা চলে। ভাষার ছন্দ ও ঝঙ্কার তাদের মনে যে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তার নাম দিয়েছে তারা ‘আইন-সঙ্গত যাদু।’
খাঁটি সিমাইট অর্থাৎ আরবরা কোন বড় আর্টের জন্মদান বা বিকাশ সাধন করে নাই। তাদের সৌন্দর্য-পিপাসা ভাষার ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। গ্রীকরা তাদের মূর্তি ও ভাস্কর্যের গর্ব করত; কিন্তু আরবরা তাদের গীতি কবিতায় এবং ইহুদীরা তাদের ধর্ম-সঙ্গীতে যেভাবে আত্মপ্রকাশ করত, তার পদ্ধতি নিঃসন্দেহ রকমে উন্নততর। আরবীতে প্রবাদ আছে : ‘মানুষের বাগীতার মধ্যেই তার সৌন্দর্য’। পরবর্তী যুগের প্রবাদ বলে : ‘জ্ঞান তিন চীজের উপর অবতীর্ণ হয়েছে : ফিরিঙ্গীর মগজ, চীনাদের হাত আর আরবদের জিভ’। পদ্যে হোক আর গদ্যেই হোক, শক্তিমান ভাষায় সুন্দরভাবে নিজ কথা বলতে পারাকে আরবরা বাগ্মীতা বলে। আইয়ামে জাহেলীয়ার যুগে পূর্ণ-মানুষ হতে তিনটি মৌলিক গুণের প্রয়োজন ছিল : বাগ্মীতা, তিরন্দাজী ও অশ্বচালনায় দক্ষতা। আরবী ভাষার গঠন-বৈশিষ্ট্য হেতু এ ভাষায় অল্প কথায় বড় ভাব প্রকাশ করা চলে। ইসলাম ভাষার এই বৈশিষ্ট্য এবং জাতির এই মনোভাবের ষোল-আনা সদ্ব্যবহার করেছে। এই জন্যই মুসলমানেরা বলে, ইসলাম যে খাঁটি ধর্ম তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, কোরআনের ভাষার অলৌকিক সৌন্দর্য ও রচনা দক্ষতা। ইসলামের বিজয় কতকাংশে ছিল একটি ভাষার বিজয়–বিশেষ করে একটি গ্রন্থের ভাষার বিজয়।