লিংকন কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন :
লিংকন কীভাবে তার বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন? সৌভাগ্যবশত আমরা তা জানি এবং এখানে আপনারা সে পদ্ধতি জানতে পারবেন। লিংকন এক শতাব্দীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ কাল কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন। বক্তৃতা প্রস্তুতে তিনি যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন ডীন ব্রাইন তর বিভিন্ন ভাষণে তা ব্যক্ত করেছেন। লিংকনের একটি বিখ্যাত ভাষণে তিনি ভবিষ্যদ্বক্তার মতো বলে ছিলেন, আভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত কোনো ঘর টিকে থাকতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, অর্ধস্বাধীন ও অর্ধদাস কোনো সরকারও স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারে না। এই বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে তাঁর মন হতেই উৎসারিত হয়েছিল। কেননা তিনি তার স্বাভাবিক কাজে, পানাহারের সময়, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় গোদোহন কালে দোকনে কেনা কাটার সময়, বাজারে ঘোরার সময় ছোট ছেলেটিকে নিয়ে বসে থাকার সময়, পিতার সাথে আলোচনার সময় দেশ সম্পর্কে, সরকার সম্পর্কে, দেশের অবস্থা সম্পর্কে ভাবতেন, চিন্তা করতেন, সকলের সাথে আলাপ করতেন মত বিনিময় করতেন, এবং এরই ফলশ্রুতিতে তার পক্ষে এই ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব হয়েছিল। তবে এই বক্তব্য পেশ কালে লিংকন সম্পূর্ণরূপে নিজের চিন্তাকে নিজের ভাষাতেই প্রকাশ করেন, ফলে ঐটি হয় হৃদয়গ্রাহী।
সব সময় তিনি যা চিন্তা করতেন মনে যা আসত তা হাতের কাছে পাওয়া টুকরো কাগজ, খাম, ভেঁড়া খামের অংশ ইত্যাদিতে লিখে রাখতেন, কখনো লিখতেন পুরো বাক্য কখনে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। অতঃপর এ সব কগজের টুকরো তিনি সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং সময় ও সুযোগে মতো বসে এগুলোকে সঠিক ভাবে সাজিয়ে নিতেন, লিখতেন, সংশোধন করতেন, সংযোজন করতেন, সম্প্রসারণ করে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন, প্রকাশনার জন্যে উপযোগী করে নিতেন।
১৮৫৮ সালের যৌথ বিতর্ক কালে সিনেটর ডগলাস সর্বত্র একই বক্তব্য পেশ করতে শুরু করেন। কিন্তু লিংকনের নীতি ছিল, নতুন কথা বলা। এক সভায় যা বলেছেন অন্যত্র তার পুনরাবৃত্তি না করা। তাই তিনি সব সময় তার বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করতেন, তাই তার পক্ষে নতুন নতুন বক্তব্য পেশ করা সহজতর হত। এই নতুন বক্তব্য শ্রোতাদের কাছে হত অনেক সহজ ও গ্রহণযোগ্য।
হোয়াইট হাউসে প্রবেশের স্বল্প কাল আগে তিন শাসনতন্ত্রের একটি অনুলিপি নেন। অতঃপর তিনি ঐটি নিয়ে স্প্রিংফিল্ড এর একটি কক্ষে প্রবেশ করেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শাসনতন্ত্রের উদ্ধৃতি নিয়ে তিনটি বক্তৃতা প্রস্তুত করেন। এভাবেই তিনি হোয়াইট হাউসের উদ্বোধনী বক্তৃতা প্রস্তুত করেন।
লিংকন কীভাবে তার গেটিসবার্গের বিশ্ব বিখ্যাত বক্তৃতা তৈরি করেছিলেন? দুর্ভাগ্য বশত এই ভাষণটি তৈরি করা সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচারিত আছে। কিন্তু এর সত্য ঘটনা হচ্ছে নিম্নরূপ :
গোটিসবার্গ গোরস্থান পরিচালনা কমিশন আনুষ্ঠানিক উৎসর্গানুষ্ঠান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এডওয়ার্ড এভারেটকে বক্তৃতাদানের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। মি. এভারেট বোস্টমেন মন্ত্রী, হারভার্ড এর প্রেসিডেন্ট, নিউইয়র্কের গভর্নর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং মন্ত্রী হিসাবে আমেরিকায় বিশেষভাবে পরিচিত, খ্যাতনামা বক্তা। প্রথমে ১৮৬৩ সালের ২৩শে অক্টোবর এই অনুষ্ঠানের তারিখ নির্দিষ্ট করে তাকে আমন্ত্রণ জানান হয়। কিন্তু এভারেট জানান যে এত অল্প সময়ের মধ্যে তার পক্ষে বক্তৃতা প্রস্তুত করা সম্ভব হবে না। সুতরাং তাকে বক্তৃতা প্রস্তুতির সময় দেয়ার নিমিত্তে এই অনুষ্ঠান ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় এক মাস কাল স্থগিত রাখা হয়। মি. এভারেট অনুষ্ঠানের তিনদিন আগে গেটিসবার্গ গমন করে, যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে, যুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করেন। ফলে যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার প্রস্তুতি হয় সম্পূর্ণ।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে কংগ্রেসের সকল সদস্য, প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রীসভার সদস্যদের কাছে আমন্ত্রণ পত্র পঠানো হয়। অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত হতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট লিংকন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন জানালে কমিটি বিস্মিত হয়। তারা কি প্রেসিডেন্টকে ভাষণ দেবার জন্যে অনুরোধ জানাবেন? তাদের এরূপ কোনো ইচ্ছা ছিল না। আপত্তিও উত্থাপিত হয়। তিনি প্রস্তুতির সময় পাবেন না। অধিকিন্তু সময় পেলেও এরূপ বক্তৃতা প্রণয়নের যোগ্যতা তার আছে কি? দাসতু অথবা শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে বিতর্কে তিনি যক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশে সক্ষম হলেও তাঁকে উৎসর্গমূলক বক্তৃতা প্রদান করতে কেহ কখনো দেখে নি। এটি হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তাঁরা কি করিবেন তা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হলেন। তাঁরা কি তাকে বক্তৃতা করতে অনুরোধ জানাবেন? তারা শুধু বারবার ভাবতে লাগলেন কী করা যায়। কিন্তু এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, যে ব্যক্তির যোগ্যতা সম্পর্কে মনে প্রশ্ন জেগেছিল সেই ব্যক্তিরই সেদিনকার ভাষণটি আজ সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ বলে বিবেচিত ও পরিচিত, কোনো জীবন্ত মানুষের বক্তৃতার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠতম বক্তৃতা বলে গণ্য।