এক শতাব্দীর তিনভাগের এক ভাগ সময় হারবার্ড -এর সভাপতি থাকার পর ড. চার্লস ডব্লিউ, ইলিয়ট একবার বলেছিলেন, অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটা বুঝেছি যে, মাতৃভাষা যথাযথ ভাবে শেখাই হচ্ছে যে কোনো ভদ্রলোক বা মহিলার জন্যে প্রকৃত শিক্ষা। এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু কীভাবে আমরা শব্দকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করে সুন্দর ও যথাযথ বাক্য প্রকাশ করব, এতে অবশ্য কোনো গোপন তথ্য নেই। পদ্ধতিটা ওপেন সিক্রেট। লিংকন সাফল্যের সাথে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। অন্য কোনো আমেরিকানই এত সুন্দর ভাবে ভাষা প্রয়োগ করতে পারেন নি। কারো প্রতি শত্রুতা নয় সকলে প্রতি বদান্যতা। লিংকন, যাঁর পিতা ছিলেন একজন অশিক্ষিত সুতার এবং মাতা ছিলেন একজন অপরিজ্ঞাত মহিলা, প্রকৃতির অফুরন্ত দানে কি তিনি এরূপ শব্দ ভাণ্ডারের অধিকারী হয়েছিলেন? এই ধারণার পক্ষে সমর্থক কোনো প্রমাণ নেই। কংগ্রেসে নির্বাচিত হবার পর তিনি নিজের শিক্ষা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “ত্রুটিপূর্ণ” এই বিশেষণ লিখে। এই রেকর্ড আছে ওয়াশিংটনে। সমগ্র জীবনে তিনি বার মাসেরও কম সময় স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। তবে তাঁর জীবন গঠন করেন কে। কেন্টারকীর জাসারিয়া বার্বি ও কালের হ্যাঁজেল ইন্ডিয়ানার আজেল ডোরসে, আন্ড ক্রফোর্ড এবং পিজিয়ন ক্রিক এর অসম্ভব প্রভাব তাঁর ওপর। তবে তিনি সবচাইতে বড় শিক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতি থেকে পরিবেশ থেকে।
ইলিওনয়েসের কৃষক ও ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও মক্কেলদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তিনি প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। লিংকন কখনো তার চাইতে কম বিদ্যার লোকদের সাথে সময় কাটাতেন না। বিদ্বান, শিক্ষিত ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথেই তিনি চলাফেরা করতেন। বার্নস বাইরন ও ব্রাউনের সমগ্র রচনা তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। বার্নস এর উপর তিনি একটি বক্তৃতা লিখেছিলেন, বাইরনের কবিতার একটি কপি তাঁর অফিসে এবং অপর একটি কপি তার বাড়িতে সব সময় মজুদ ছিল। এটা এত বেশি ব্যবহার করতেন যে, অফিসের কপিটি সব সময় খোলাই থাকত। হোয়াইট হাউসে থাকা কালে এবং গৃহযুদ্ধের তীব্র সংকট কালেও তিনি বিশ্রামকালে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে হুডস এর কবিতা পড়তেন। কখনো কখনো রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে গেলে তিনি বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পড়তেন। কখনো-কখনো তিনি নৈশ পোশাক নিয়ে চটি পায়ে ওঠে পড়তেন, পায়চারী করতেন এবং সেক্রেটারি ঘুম থেকে উঠলে তাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। হোয়াইট হাউসে বসে তিনি শেক্সপিয়ার মুখস্থ করতেন, নায়কদের চরিত্র সম্পর্কে ব্যক্তিগত মতামত লিখতেন। আমি শেক্সপিয়ারের কতিপয় নাটক পড়েছি, নায়ক হ্যাঁক্টেকে তিনি লিখেছিলেন, তবে আমার পেশা পাঠ নয়। আমি লীয়ার, রিচার্ড -৩, হেনরী –৮, হ্যাঁমলেট পড়েছি। আমার মনে হয় ম্যাকবেথের সাথে কোনোটি তুলনীয় নয়। এটা আশ্চর্য সৃষ্টি।
লিংকন সব সময় রচনাকর্মে লিপ্ত থাকতেন, কবিতা লিখতেন। তিনি শুধুমাত্র কোনো বিষয় মুখস্থ করতেন না, নিজে-নিজে ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রকাশ্যে আবৃত্তি করতেন, লিখতেন। বোনের বিয়ের সময় তিনি স্বরচিত একটি দীর্ঘ কবিতা পড়েছিলেন। মধ্যরাতে তিনি কবিতা লিখে দীর্ঘ একটি নোট বই পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু নিজের লেখা সম্পর্কে তিনি এতবেশি লাজুক ছিলেন যে নিকটতম বন্ধুকেও তা পড়তে দিতেন না। ”পণ্ডিত ব্যক্তি লিংকন” বইতে রবিনসন লিখেছেন, “এই স্বশিক্ষিত লোকটির মন ছিল অত্যন্ত সংস্কৃতিবান, এটাকে প্রতিভা অথবা মেধা যা-ই বলুন না কেন,” অধ্যাপক এবারটন তার সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি স্কুলে যান নি, অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষালাভ করেছেন। নিজস্ব উদ্যোগ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শিক্ষালাভের এরূপ উদাহরণ নিতান্ত বিরল।”
নিজের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফলে, কোনোরূপ শিক্ষকের সাহায্য ও সহায়তা ছাড়া তিনি শুধুমাত্র শিক্ষিত হন নি, একজন খ্যাতনামা বক্তাও হয়েছিলেন, কঠোর পরিশ্রম তাকে এই সুযোগ এনে দিয়েছিল। তাঁর বক্তৃতায় শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে গেটিসবার্গের ভাষণ, একটি জীবন্ত কোনো ব্যক্তির শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। যুদ্ধেলিপ্ত একশত ৭০ হাজার লোকের মধ্যে সাত হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। চার্লেস সামার লিংকনের মৃত্যুর অব্যবহিত পর বলেছেন, যুদ্ধের স্মৃতি মানুষ ভুলে গেলেও লিংকনের বক্তৃতা ভুলবে না। এবং এই বক্তৃতার জন্য মানুষ একদিন স্মরণ করবে এই যুদ্ধের কথা। এই ভবিষ্যৎ বাণীর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কেহ কোনোরূপ সন্দেহ করতে পারেন?
এডওয়ার্ড এভারেট গেটিসবার্গে দু’ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করেছিলেন, তার বক্তৃতা মানুষ বহুদিন আগে ভুলে গেছে। লিংকন বক্তৃতা করেছেন দু’মিনিটেরও কম সময়। একজন ফটোগ্রাফার বক্তৃতাকালে লিংকনের ফটো তুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তার ক্যামেরা ঠিক করার আগেই লিংকন তার বক্তৃতা শেষ করে ফেলেন।
কিন্তু লিংকনের বক্তৃতার ভাষা অত্যন্ত উন্নত ছিল বিধায় ইংরাজি ভাষার আদর্শ হিসাবে তার অনুলিপি অক্সফোর্ডের একটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। বক্তৃতা কোর্সের সকল ছাত্রই এই বক্তৃতাটি মুখস্থ করেন।
আজ থেকে ৮৭ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই মহাদেশে এমন একটি স্বাধীন জাতির জন্ম দেন যে জাতি বিশ্বাস করতেন যে জন্মসূত্রে প্রত্যেকটি মানুষ স্বাধীন ও সমান। আমরা এক ব্যাপক গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। এই গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে পরীক্ষা হচ্ছে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এই জাতি বা অন্য কোনো জাতি দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে কিনা, আমরা, এই বিরাট যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের এক কবরগাহে আজ সমবেত হয়েছি, জাতির ভবিষ্যতের জন্য যারা আত্মাহুতি দিয়েছে তাদের কবর এখানে। আমাদের কর্তব্য হিসাবে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি আত্মাহুতিদানকারীদের স্মরণ করে এই কবরগাহকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারছি না। জীবিত ও মৃত সাহসী যোদ্ধারা যারা এখানে যুদ্ধ করছেন তারাই এটিকে পবিত্র স্থান পরিণত করছেন, আমাদের ক্ষুদ্র শক্তি তাতে নতুন কিছুই যোগ করতে পারে না। আমরা আজ এখানে কী বলছি তা দীর্ঘদিন কারো স্মরণ থাকবে না। কিন্তু বীরেরা এখানে কী করেছিল তা কেহ কোনোদিন ভুলবে না। সুতরাং এক্ষণে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আত্মাহুতিদানকারী বীর যোদ্ধাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য আত্মনিয়োগ করা আমাদের কর্তব্য যাতে তাদের আত্মদান বৃথা যেতে না পারে। কারণ এই জাতি স্বাধীনতার নব অর্থদান করেছে। তাদের দ্বারা গঠিত সরকার হচ্ছে জনগণের সরকার, যা জনগণের দ্বারা জনগণের জন্যে গঠিত। আমাদের চেষ্টা করতে হবে এর অর্থ যেন বিকৃত না হয়।