এখানে ব্যবহৃত ‘একগুয়ে ও অবাধ্য’ কারো দৃষ্টি তেমন আকর্ষণ করে না তবে বেত্রদণ্ড বা প্রহার শব্দ শুনলে সবাই একটু চঞ্চল হয়।
জীবনী লেখার পুরাতন পদ্ধতি এবং নতুন পদ্ধতি এক নয়। পুরাতন পদ্ধতির লেখক লেখেন, জন ডোর জন্ম হয় গরিব কিন্তু সৎ পরিবারে। নতুন পদ্ধতির লেখকের ভাষা হয়, জন ডোর পিতা পুত্রকে নরম জুতো কিনে দিতে পারেন না বিধায় শীতকালে পা গরম রাখার জন্যে তিনি ছালা দিয়ে জুতা মোড়ান, দারিদ্র্য সত্ত্বেও তিনি কিন্তু দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করেন না। ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তার পিতামাতা ‘গরিব কিন্তু সৎ।‘ তা নয় কি? দ্বিতীয় পদ্ধতি কি প্রথম পদ্ধতির চাইতে বেশি আকর্ষণীয় নয়?
আধুনিক জীবনীকারদের এই পদ্ধতি আধুনিক বক্তারাও অনুসরণ করতে পারেন।
আরো ব্যাখ্যা দিচ্ছি। মনে করুন, আপনি বলতে চান যে নায়াগ্রায় প্রতিদিন যে সম্পদ নষ্ট হয় তা আতঙ্ক জনক। অতঃপর আপনি বলেন, এই সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে অনেক লোকের উপকার হত দেশের কল্যাণ হত, এই ধরনের বক্তব্য কি শ্রোতার আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং আকর্ষণীয় হয়? না, না ‘ডেইলী সায়েন্স নিউজ বুলেটিনে এডুইন এস, সোলোমেন যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তা কি অধিক আকর্ষণীয় নয়? সোলোমেন লিখেছেন :
আমাদিগকে বলা হয়েছে যে, এই দেশে লাখ-লাখ লোক দারিদ্র পীড়িত এবং অপুষ্টিতে ভুগছে, একই সময় প্রতিঘণ্টায় নায়াগ্রায় আড়াই লাখ করে রুটি নষ্ট হচ্ছে, মনশ্চক্ষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রতি ঘন্টায় উঁচু গিরিচূড়ায় ছয় লাখ ডিম পড়ছে এবং ঘূর্ণিস্রোত তা দিয়ে বিরাটকায় ওমলেট তৈরি করছে। এই ঘূর্ণিস্রোত যে কোনো সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম, সুতরাং জলপ্রপাতের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করা প্রয়োজন।
ছবি সৃষ্টিকারী শব্দ :
যে শব্দ বললে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছবি তা স্মরণ রাখা সহজতর। সাধারণ বক্তারা তা জানেন না, যে বক্তা শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রোতার চোখের সামনে ছবি সৃষ্টি করতে পারবেন সে বক্তার বক্তব্য সহজে মনে থাকবে।
ছবি, ছবি, ছবি। এমনভাবে কথা বলুন যাতে শ্রোতা আপনার কথাকে ছবির সাথে মেলাতে পারে। তাতে আপনার বক্তব্য হবে আকর্ষণীয়, সহজ এবং তা মনে রাখা যাবে অত্যন্ত সহজে।
এই ক্ষেত্রে নায়াগ্রা সম্পর্কে ডেইলি সায়ন্স নিউজ বুলেটিন থেকে উদাহরণ দিচ্ছি। নায়াগ্রার উঁচু গিরিচূড়ায় প্রতি ঘণ্টায় পতিত ৬ লাখ ডিম ঘূর্ণিস্রোতে বিশালাকার ওমলেট তৈরি করছে। এটা বললে সবার চোখের সামনেই একটা ছবি ভেসে ওঠে।
ফলে এর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। যেন –এটি একটি ঘূর্ণীয়মান ছবি।
‘স্টাইলের দর্শন’ শীর্ষক এক নিবন্ধে হারবার্ট স্পেনসার লিখেছেন :
“আমরা চিন্তা করি না,“ বলেছেন তিনি, “সাধারণ ভাবে, কিন্তু চিন্তা করি বিশেষ বা নির্দিষ্ট বিষয়ে।”
“যে জাতি যত বর্বর সে জাতির দণ্ডবিধি তত বেশি কঠোর।”
এটাকে আমরা এভাবে সাজাতে পারি, বর্বর জাতি অপরাধের সাজা দেন ফাঁসি দিয়ে, পুড়িয়ে মেরে।
বাইবেলে এবং শেক্সপিয়ারের লেখায় ছবি সৃষ্টিকারী শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। শেক্সপিয়ার তাই শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে অদৃশ্যকে দৃষ্টি গোচর করেছেন।
গিলটি করা স্বর্ণকে তিনি খাঁটি সোনা করেছেন। তিনি বলেছেন, চকচক করলেই সোনা হয় না।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সে সব প্রবাদ বাক্য চলে আসছে তার কি প্রভাব নেই জন মনে? যেমন, হাতের একটি পাখি বনের দুটির চেয়ে মূল্যবান, সময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু, অসারের তর্জন গর্জনই সার, আগে তো ঘর তবে তো পর, আত্মবৎ মান্যতে জগৎ, অথবা সে রামও নাই, সে অযোধ্যা নাই। এসবের অবশ্যই স্থায়ী প্রভাব আছে।
লিংকন সাধারণত এসব প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করতেন। কোনো নথি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করে হোয়াইট হাউসে তার টেবিল এলে তিনি তাতে এসব প্রবাদ বাক্য প্রয়োগ করে নোট দিতেন, তাঁর ভাষা এরূপ জীবন্ত হত, ভাষা পাঠে চোখের সামনে ছবি ভেসে উঠত, তাই তা সব সময় স্মরণ থাকত। ”আমি যখন কোনো লোককে ঘোড়া কিনতে পাঠাই,“ তিনি বলেন, “আমি তখন জানতে চাই না ঘোড়াটির লেজে কয়টি চুল আছে। আমি একটি আস্ত ঘোড়াই চাই।”
বৈশাদৃশ্যের প্রতি আকর্ষণ :
মেকলে চার্লস -১এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। বৈসাদৃশ্য পূর্ণ দৃশ্য ছবি, বা শব্দ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই মেকলে তা ব্যবহার করেছেন।
মেকলে বলেন, আমরা তার বিরুদ্ধে সিংহাসনে আরোহণ কালে যে শপথ গ্রহণ করেছেন তা ভঙ্গ করার অভিযোগ আনলে আমাদের জানানো হয় যে, তিনি তাঁর বিবাহের শপথ রক্ষা করেছেন। জনগণের প্রতি অবজ্ঞা ও নিষ্ঠুরতার অভিযোগ আনলে আমাদের বলা হয় যে, তিনি তার শিশু সন্তানকে হাঁটুর ওপর রেখে চুমু দিচ্ছেন। জনগণের অধিকার লংঘনের অভিযোগ আনলে জানানো হয় যে, সকাল ৬টায় তিনি এসব অভিযোগ শ্রবণ করেন। তবে তাঁর সুন্দর চেহারা ও সুন্দর দাড়ির জন্যে অতঃপর আমরা ক্রুদ্ধ হতে পারি না।
সংক্রামকের প্রতি আকর্ষণ :
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এমন সব দ্রব্যের কথা আলোচনা করেছি যার প্রতি শ্রোতাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। যে কেহ এসব উপদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করতে পারেন, তা হলেও কিন্তু সব সময় সফল হবেন না। মানুষের মন আকর্ষণ অত্যন্ত সূক্ষ ব্যাপার। এটা অনুভূতি নির্ভর। এটা যান্ত্রিক ইঞ্জিন চালনা নয়। এটার জন্যে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বলা যায় না। আগ্রহ সৃষ্টি হলে তা স্মরণীয় হয়।