একদা প্রয়াত লর্ড নর্থক্লিফকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মানুষ কিসে আগ্রহী। তিনি এক শব্দে উত্তর দিয়েছিলেন নিজেদের সম্পর্কে। নর্থক্লিফ ছিলেন গ্রেট বৃটেনের সবচাইতে ধনী সংবাদপত্র মালিক।
আপনি কী ধরনের লোক তা কি আপনি জানতে চান? এটা একটা আকর্ষণীয় বিষয়। আমরা আপনার সম্পর্কে আলোচনা করছি। আমাদের আলোচনা আপনার সামনে দর্পণ হিসাবে কাজ করবে। এই আলোচনা সম্পর্কে অধ্যাপক জেমস হার্ভে রবিনসনের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, আলোচনায় মন-ই প্রতিফলিত।
আমরা যখন সজাগ থাকি তখন চিন্তা করি। ঘুমের মধ্যেও চিন্তা করি এবং ঘুম থেকে জেগেও চিন্তা করি। আমাদের চিন্তাকালে বাস্তব কিছু এলে তাকে ভিত্তি করেই আমাদের চিন্তা আবর্তিত হয়। এটাই আমাদের চিন্তার বাস্তব পথ। আমরা আমাদের চিন্তাকে নিজস্ব গতিতে আবর্তিত হতে দিই। ফলে এতে আমাদের পছন্দ অপছন্দ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভীতি, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা ও ঘৃণা সবকিছুই আবর্তিত হয়। আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ছাড়া আর কোনো বিষয়ে এত অধিক আগ্রহী নই। অহংবোধ বা স্বার্থপরতার চাইতে বড় কিছু আমাদের নেই। আমরা প্রয়োজনে নিজেদের স্বার্থ সত্যকেও পরিহার করে চলি।
গোপন কথা, অব্যক্ত কথা আমাদের চরিত্রে প্রতিফলিত। এসব কথা এসব বেদনার প্রভাব আমাদের চরিত্রের অনস্বীকার্য।
সুতরাং স্মরণ রাখবেন যে, নির্দিষ্ট সময়ের কর্ম ব্যস্ততার পর প্রতিটি মানুষ শুধুমাত্র নিজের সম্পর্কে ভাবে, চিন্তা করে। স্মরণ রাখবেন যে, ইটালি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দেনা শোধ করল সে কথা ভাবার চাইতে কে ভালো পাঁচক সেই কথাটাই সাধারণ মানুষ ভাবে বেশি। দক্ষিণ আমেরিকার বিল্পবের চাইতে ধারহীন ব্লেডের প্রভাবই একজন সাধারণের ওপর বেশি। ভূমিকম্পে এশিয়ার পাঁচ লাখ লোক মরেছে একথা বললে, একজন মহিলা যত কষ্ট পাবে, নিজের দাঁতের ব্যথায় কষ্ট তার জন্যে তার চাইতে বেশি। ইতিহাসের দশজন খ্যাতনামা ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি যা বলবেন তা শোনার চাইতে নিজের সম্পর্কে আপনাকে কিছু শোনাতে সে অধিক আগ্রহী।
কীভাবে সদালাপী হওয়া যায় :
অধিকাংশ ব্যক্তি নিজেরা যে বিষয়ে আগ্রহী শুধু সে বিষয়ে বলে, তাই তারা সদালাপী হতে পারে না। এরূপ আলাপ শ্রোতাদের জন্যে হয় অনাকর্ষণীয় ক্লান্তিকর। শ্রোতার বিষয়, তার ব্যবসা তার গলফ খেলার পদ্ধতি তার সাফল্য অথবা কোনো মাতার সাথে আলোচনা কালে তার শিশুদের সম্পর্কে আলোচনা করুন, আলোচনা আকর্ষণীয় হবে। এই ধরণের আলোচনায় আপনি শ্রোতাকে আনন্দ দানে সক্ষম হবেন, ফলে আপনি একজন সদালাপী বলে পরিগণিত হবেন।
বক্তৃতা কোর্সের এক সমাপনী ভোজে ফিলাডেলফিয়ার মি. হ্যারল্ড ডুইট অত্যন্ত সাফল্যজনক একটি বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন। তিনি কোর্স শুরু করার দিন থেকে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়, কার সাথে কীভাবে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে তা ব্যক্ত করেন। ব্যক্ত করেন প্রতিটি কথা রসাল করে, প্রাঞ্জল ভাষায়। তিনি বলেন কার সাথে কখন কী বিষয়ে আলোচনা করেছেন, ফলে তাঁর বক্তৃতা হয় অত্যন্ত আকর্ষণীয়, সবাই এতে আনন্দ পায়, সন্তোষ লাভ করে। এই ধরনের বিষয় নিয়ে বক্তৃতা করলে কারো ব্যর্থ হবার কারণ ঘটে না! এটা অত্যন্ত আদর্শ নিয়ম। নিজের সম্পর্কে শোনার জন্যে প্রতিটি মানুষই আগ্রহী হয়। মি. ডুইট জানতেন, কীভাবে মানব চরিত্র মোচড়ানো যায়। তাই তিনি সেদিন উপস্থিত সকলের কথা বলে সাফল্য লাভ করেন।
যে-আদর্শ বিশ লাখ পাঠক আকর্ষণ করে :
কয়েক বছর আগে আমেরিকান ম্যাগাজিনের প্রচার সংখ্যা খুব বেড়েছিল। এতো বেড়েছিল যে, প্রকাশনা জগতে তা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এর গোপন রহস্য কী? এই রহস্য হচ্ছে প্রয়াত জন, এম, সিডাল এবং তাঁর আদর্শ। যখন আমার সাথে পরিচয় হয় তখন মি. সিডাল ছিলেন পত্রিকাটির”আকর্ষণীয় ব্যক্তি বিভাগের প্রধান। আমি তার জন্যে কতিপয় নিবন্ধ লিখি। একদিন তিনি আমার সাথে দীর্ঘ সময় আলোচনা করেন।
“জনগণ স্বার্থপর” তিনি বলেন, “তারা শুধুমাত্র তাদের সম্পর্কেই আগ্রহী। সরকার রেল রোডের মালিকানা নিবে কিনা সে সম্পর্কে তারা মোটেই আগ্রহী নয়, তারা আগ্রহী কীভাবে উচ্চ পদ পাওয়া যায়, বেশি টাকা রোজগার করা যায় এবং কীভাবে স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়। আমি যদি পত্রিকাটির সম্পাদক হতাম, তিনি বলেন, “আমি তাদের বলতাম কীভাবে দাঁতের যত্ন নিতে হয়। কীভাবে স্নান করতে হয়, কীভাবে গ্রীষ্মে ঠাণ্ডা থাকতে হয়, কীভাবে বাড়ি করা যায়, কীভাবে স্মরণ করা যায়, কীভাবে ব্যাকরণের ভুল পরিহার করা যায় এবং এরূপ অন্যান্য বিষয়। মানুষ সব সময় মানবিক কাহিনী শুনতে আগ্রহী। সুতরাং আমি ধনী হওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে ধনীব্যক্তি বর্ণিত কাহিনী প্রকাশ করতাম, খ্যাতনামা ব্যাংকারেরা কীভাবে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছেন সে সম্পর্কে আমি কাহিনী প্রকাশ করতাম।”
এর কিছুদিন পর সিডাল সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই সময় ম্যাগাজিনটির প্রচার সংখ্যা ছিল সীমিত। সম্পাদক হয়ে মি. সিডাল তার বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এর ফলে কী হয়? এর ফল অকল্পনীয়। প্রচার সংখ্যা দু’শ হাজার, তিনশ’ হাজার, পাঁচলাখ হয়ে যায় দ্রুত তালে। এতে জনগণ তাদের মনের খোরাক লাভ করে। এক মাসের মধ্যে ক্রেতার সংখ্যা হয় ১০ লাখ, পরে পনের লাখ এবং পরিশেষে বিশ লাখ। ওখানে এটি থেমে থাকে নি, বছরের পর বছর প্রচার সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে। সিডাল পাঠকের স্বার্থের কথা বলতে পেরেছিলেন বলেই এরূপ হয়েছিল।