আমি ধর্মযাজককে ছোট করতে চাই না। তবুও সত্যি কথা এই যে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে বললে তার যে বক্তব্য ফলপ্রসূ হত, এসব সৈনিকদের কাছে তা ব্যর্থ হয়। সৈনিকরা বুঝতে পারেন না, তাদের কেন এসব কথা বলা হচ্ছে, আর বক্তাও বুঝতে পারেন না, কেন তিনি এসব বলছেন।
আমাদের মতে একটি বক্তৃতার অর্থ কী? যে কোনো বক্তৃতায় বক্তার মুলত চারটি লক্ষ্য থাকে। সে গুলো কী?
১। কোনো একটি বিষয় পরিষ্কার করা।
২। শ্রোতাদের স্বমতে আনা।
৩। উদ্দীপ্ত করা।
৪। আনন্দ দান।
কতিপয় বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যাক।
কারিগরি কাজের প্রতি লিংকন সব সময় আগ্রহী ছিলেন। একবার বালিতে আটকা পড়া নৌকা উদ্ধারের জন্যে তিনি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর আইন দপ্তরের সন্নিকটে অবস্থিত একটি কারিগরি কারখানায় বসে তিনি অনেক খেটে, পরিশ্রম করে তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের একটি মডেল তৈরি করেন। তাঁর এই পরিকল্পনা পরিশেষে ব্যর্থ হলেও তিনি ছিলেন এ সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী। যখন বন্ধুরা তার কাছে আসতেন মডেল দেখতে, তিনি মডেল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে কখনো ক্লান্তি বোধ করতেন না। তার মূল লক্ষ্য ছিল সকলের কাছে তার ধারণা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরা।
যখন তিনি তার গেটিসবার্গের অমর ভাষণ দান করেন, যখন তিনি তার প্রথম দ্বিতীয় উদ্বোধনী ভাষণ দান করেন এবং যখন তিনি হেনরী ক্লের মৃত্যুর পর তার জীবনী আলোচনা করে বক্তৃতা করেন, লিংকনের মূল লক্ষ্য ছিল নিজের বক্তব্য পরিষ্কার ভাবে বলে, শ্রোতাদের স্বমতে আনা। অবশ্য এসব বক্তৃতার বক্তব্য পরিষ্কার করে তুলে ধরার চাইতে শ্রোতাদের স্বমতে আনার উপরই জোর পড়েছিল বেশি।
জুরিদের সাথে আলোচনা কালে লিংকন তাদের স্বমতে আনতে চাইতেন। রাজনৈতিক আলোচনায় তিনি নিজের পক্ষে ভোট প্রাপ্তির চেষ্টা চালাতেন। সুতরাং তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করা, কর্মমুখী করে তোলা।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার দু’বছর আগে লিংকন উদ্ভাবন (আবিষ্কার) সম্পর্কে একটি বক্তৃতা প্রস্তুত করেন। এই বক্তৃতা প্রস্তুতিতে তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের আনন্দ দান করা। অন্তত এই লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করেই তিনি বক্তৃতা প্রস্তুত করেছিলেন, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে তিনি সফল হতে পারেন নি। জনপ্রিয় হিসাবে তার জীবন এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল। একটি শহরে একজন শ্রোতাও তার বক্তৃতা শুনতে আসে নি।
কিন্তু অন্যান্য বক্তৃতায় তিনি অব্যাহতভাবে সাফল্য লাভ করেছিলেন, যার কথা আমি উল্লেখ করেছি। কিন্তু কেন? কারণ এসব ক্ষেত্রে তিনি তার লক্ষ্যের কথা জানতেন এবং জানতেন কী ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। তিনি জানতেন কোথায় তিনি যাবেন এবং কীভাবে যাবেন। এবং বহু বক্তা এটা ঠিক ভাবে জানেন না বলে মাঝ পথে হাবুডুবু খান।
উদাহরণ স্বরূপ–আমি একদা যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের একজন সদস্যকে বক্তৃতা কালে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে নিউইয়র্কে হিপাড্রোম (ঘোড়া দৌড়ের মাঠ) ত্যাগ করে চলে যেতে দেখেছি। কারণ, তিনি যে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, তাতে তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের কাছে তা পরিষ্কার করে তোলা। লক্ষ্য নির্ধারণ ছিল তাঁর অবিবেচনা প্রসূত, তাই তিনি হন ব্যর্থ। এটা ছিল যুদ্ধের সময়। তার বক্তব্যের বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শ্রোতারা যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো নির্দেশ শুনতে আগ্রহী ছিলেন না। তাদের লক্ষ্য ছিল আনন্দ লাভ। শ্রোতারা দশ মিনিট থেকে পনেরো মিনিট পর্যন্ত অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে তাঁর বক্তব্য শোনেন এবং আশা করেন যে এরপর আনন্দ দিয়ে তার বক্তব্য শেষ হবে। কিন্তু তা হয় না, বক্তা বার-বার যুদ্ধের প্রস্তুতি ব্যাখ্যা করতে থাকেন, শ্রোতারা আস্তে-আস্তে অধৈর্য হয়ে পড়েন, একে একে তারা চলে যেতে শুরু করেন? কেহ-কেহ স্বতস্ফূর্ত ভাবে ধ্বনিও প্রদান করতে শুরু করে একসাথে। বক্তা শ্রোতাদের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়ে বক্তৃতা অব্যাহত রাখেন। এর ফলে শ্রোতারা আরো বিরক্ত হয়। হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়। তারা বক্তাকে থামিয়ে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। তাদের ধ্বনি উচ্চ থেকে উচ্চগ্রামে পৌঁছে। পরিশেষে এমন অবস্থা হয় যে বক্তার কথা নয়, শ্রোতার কথাই শুধু শোনা যেতে থাকে। সুতরাং বক্তা ব্যর্থ হয়ে, পরাজিত হয়ে অপমানিত হয়ে বক্তৃতা শেষ করেন।
এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিন। আপনার লক্ষ্যের কথা জানুন, বক্তৃতা প্রস্তুতের আগেই লক্ষ্যস্থল সঠিক ভাবে নির্ধারণ করে নিন। কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে তা ঠিক করে নিন। অতঃপর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণে লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রস্তুতি নিন।
তুলনার মাধ্যমে বক্তব্য পরিষ্কার করুন :
কোনো বিষয় পরিষ্কার করার, বোধগম্য করার গুরুত্ব অথবা বাধাবিঘ্ন ছোট করে দেখা উচিৎ নয়। একদা আমি একজন আইরিশ কবিকে এক দিন বিকেলে তার নিজের লেখা থেকে পাঠ করে শোনাতে দেখেছি। শ্রোতাদের মধ্যে শতকরা দশজন তিনি কী বলতে চান তা বুঝতে পারেন নি।
বক্তাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রকাশ্য সভায় অথবা ঘরোয়া পরিবেশে বক্তৃতায় এরূপ ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
একবার আমি স্যার অন্সিভারলজ-এর সাথে জনসভায় বক্তৃতার সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করি। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস এবং জনসভায় বক্তৃতা দানে ৪০ বছরের অভিজ্ঞ বক্তা। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি জানান যে বক্তৃতায় সাফল্য অর্জন করতে হলে প্রথম প্রয়োজন জ্ঞান এবং প্রস্তুতি এবং দ্বিতীয় প্রয়োজন হচ্ছে, বক্তব্য পরিষ্কার করার জন্যে কষ্ট স্বীকার করা।