যা হোক আপনার সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে, প্রশিক্ষণ চর্চা আপনার শ্রোতা ভীতি দূর করবে এবং আপনার মনে আত্মবিশ্বাস ও অদম্য সাহস যোগাবে।
বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে কষ্টকর বলে চিন্তা করবেন না। যে সব ব্যক্তি কালে খ্যাতনামা বক্তা হিসাবে পরিচিত হয়ে ছিলেন তারাও তাদের জীবনের প্রথম দিকে এই ভীতি ও আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে মুক্ত ছিলেন না।
খ্যাতনামা বক্তা উইলিয়াম জেনিং ব্লায়ান স্বীকার করছেন যে প্রথম দিন বক্তৃতা করার চেষ্টা করলে কম্পনের ফলে তাঁর হাটুদ্বয় জোড়া লেগে গিয়েছিল।
মার্ক টোয়েন প্রথম দিন বক্তৃতা করতে উঠে অনুভব করেন যে, তাঁর মুখ গহ্বর তুলা দিয়ে পরিপূর্ণ এবং তার নাড়ির স্পন্দন অস্বাভাবিক রূপে বেড়ে চলেছে।
বিসমার্ক ছিলেন তাঁর সময়ের একজন দক্ষ শ্রেষ্ঠতম সেনাপতি কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি যখন জন সমক্ষে বক্তৃতা করতে চেষ্টা করতেন তখন তিনি অত্যন্ত বেকাদায় পড়তেন।
জীন জুরিস ছিলেন তাঁর সময়ের ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক বক্তা। কিন্তু ডেপুটিদের চেম্বারে তিনি একটি বছর বোবার মতো বসে কাটিয়েছেন। অতঃপর তিনি চেষ্টা করেন মুখ খুলতে।
লয়েড জর্জ স্বীকার করেছেন, প্রথমদিন আমি যখন জন সমক্ষে বক্তৃতা করার চেষ্টা করি আমি অত্যন্ত দুঃখে পতিত হই। সত্যি কথা বলতে কী আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারি নি। কেননা আমার মুখ শুকিয়ে যায়, জিহ্বা মুখ গহ্বরের সাথে লেপটে যায় এবং কোনো শব্দই নিঃসৃত হয় না আমার মুখ থেকে।
গৃহযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের পক্ষ সমর্থক খ্যাতনামা ইংরেজ বক্তা জন ব্রাইট তাঁর প্রথম বক্তৃতা করেন একটি স্কুলে সমবেত একদল অশিক্ষিত জনতার সামনে যেখানে যাত্রা পথে এত ভীত, এত চিন্তিত এবং রুষ্ট হয়ে পড়েন সে সহগামীদের তিনি বলেন, ‘বক্তৃতাকালে আমি যখন অসুবিধায় পড়ব তখন আমি নির্দেশ দেখালে তোমরা হাততালি দিও–।’
খ্যাতনামা আইরিশ নেতা চালের্স স্টাটি পারলেন প্রথম জীবনে বক্তৃতা দান কালে এতই ভীত-সন্ত্রস্থ ও বিমুঢ় হয়ে পড়তেন যে, তিনি অনেক সময়, নখ দিয়ে চিমটি কেটে নিজের মাংস ছিঁড়ে রক্ত বের করে ফেলতেন। এই তথ্য প্রকাশ করেছেন তার ভাই।
ডিজরেলি স্বীকার করেছেন যে, হাউস অব কমন্সে প্রথম দিন বক্তৃতা কালে তার মনে হয়েছিল, বক্তৃতা করার চাইতে সৈন্য বাহিনী পরিচালনা করা অনেক সহজ। প্রথমদিন তিনি পারেন নি একটি শব্দও উচ্চারণ করতে। এই অবস্থা হয়েছিল লেরিভনেরও।
ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা বক্তাদের অনেকেই প্রথমদিন বক্তৃতা করতে গিয়ে হয়েছিলেন ব্যর্থ। আজকের পার্লামেন্টে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, তরুণের বক্তৃতাই তার ভবিষ্যৎ জীবনের পুর্বাভাস। সুতরাং বক্তৃতা শিখতে হলে বা বক্তা হতে হলে প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের? বহু সংখ্যক খ্যাতনামা বক্তার জীবনী পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করে গ্রন্থকার এটা উপলব্ধি করেছেন যে, যে ছাত্র প্রথমে যত বেশি ঘাবড়ান তাঁর পক্ষে সাফল্য লাভ করা তত বেশি সহজতর।
শুধুমাত্র দু’ডজন লোকের সামনে পেশকরার উদ্দেশ্যে হলেও বক্তৃতা প্রণয়নে কতিপয় নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে চলা প্রয়োজন। কেননা বক্তব্য তৈরিতে বিশেষ চাপ ও বিশেষ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কারণ বক্তা যা কিছু বলবেন তা বলতে হবে তাকে সরাসরি ও সুষ্পষ্টভাবে। অমর সিত্ৰারো দু’হাজার বছর আগে বলে গেছেন, প্রকৃত অর্থবহ সকল সাধারণ বাচন ওদের মুখ দিয়েই নিঃসৃত হয়েছে, যারা কখনো স্নায়বিক দুর্বলতায় আক্রান্ত হন নি।
বেতারে কথিকা পেশকালেও বক্তারা প্রায় একই অনুভূতির স্বীকার হয়। এটাকে বলা হয় মাইক্রোফোন-ভীতি। চার্লি চাপলিন একদা লিখিত বক্তব্য নিয়ে বেতারে পেশ করতেন। এখন তিনি দর্শক, শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ নাইট-ইন এ মিউজিক হল খ্যাত ইংল্যান্ডের মঞ্চাভিনেতা তিনি এখন। এতদসত্ত্বেও নেতার ভাষণের সুসজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করে তিনি তখন তলপেটে এরূপ যন্ত্রণা অনুভব করেন যে, সে রূপ যন্ত্রণা ফ্রেব্রুয়ারি মাসের ঝড়ের সময় আটলান্টিক অতিক্রম কালে সাধারণত অনুভূত হয়।
খ্যাতনামা চলচ্ছিত্রাভিনেতা ও পরিচালক জেমস ঝিকউডও অনুরূপ অভিজ্ঞতার অধিকারী। মঞ্চ হতে তিনি জনশূন্য ময়দানের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে অভ্যস্ত, কিন্তু মঞ্চ হতে নেমে তিনি হয়ে পড়তেন বিচলিত। প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা করার চাইতে শক্ত কাজ আর নেই, তিনি মন্তব্য করেন।
কিছু লোক যারা সবসময় বকবক করেন, তাঁরা মনে করেন যে, তাঁরা জনসমক্ষে বক্তৃতা করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে বক্তৃতা করতে দিলে তারা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে যান।
এমনকি লিংকনও প্রথম কয়েক মুহূর্ত লজ্জানুভব করতেন। তাঁর কৌশলী বন্ধু হার্ডন বলেছেন, ‘প্রথমে তিনি হয়ে পড়তেন হতবুদ্ধি, মনে হত তিনি যেন কঠোর পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত! তবে তিনি চেষ্টার ফলে অবস্থা কাটিয়ে উঠতেন এবং বেঢপ অবস্থা হতে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন। আমি প্রায়ই এটা অবলোকন করতাম এবং আমার সহানুভূতি জাগত লিংকন এর প্রতি। যখন তিনি বক্তৃতা শুরু করতেন, তখন তার আওয়াজ অস্পষ্ট হতে স্পষ্ট হত, নিম্ন হতে উচ্চ পর্যায়ে উঠত। অপ্রতিভ ভাব আস্তে-আস্তে হত দুরীভূত। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সমস্ত প্রতিকূল অবস্থা নিজের আয়ত্বে আনতে সক্ষম হতেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর অপ্রতিভ ভাব সম্পূর্ণ দূর হয়ে যেত, এবং তিনি হয়ে পড়তেন একজন দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যক্তি ও সুবক্তা।