মানুষকে অনেক সুখ-সুবিধে এনে দিয়েছিল এই দুশো বছর। এনেছিল অনেক পরিবর্তন। সব কাহিনি শোনাতে গেলে ডেনটন-এলিজাবেথিটার কাহিনি থেকে সরে যেতে হবে আমাদের। আকাশে ওড়া যে সম্ভবপর তা কি কেউ কল্পনাও করতে পেরেছিল দুশো বছর আগে? উপযুপরি আবিষ্কারের পর আবিষ্কারে সম্ভব হয়েছিল এহেন অসম্ভব কাণ্ডও। হেঁশেল নিয়ে আটকে থাকতে কেউ আর চায়নি, অসংখ্য হোটেল নিয়েছিল রান্নাবান্না এবং উদরপূর্তির দায়িত্ব। চাষবাস নিয়ে যারা চিরকাল মাঠেঘাটে, খেতখামারে কাটিয়েছে, আস্তে আস্তে তারা নিবাস রচনা করেছিল শহরে। গোটা ইংল্যান্ডে শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল চারটে শহর-বিরাট শহর! লক্ষ লক্ষ মানুষ আস্তানা নিয়েছিল এক-একটা শহরে। শহরতলির বাড়িঘরদোরগুলো ভূতুড়ে বাড়ি হয়ে উঠেছিল এই দুশো বছরে–মানুষজন কেউ থাকত না সেসব বাড়িতে।
বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বটে ডেনটন আর এলিজাবেথিটা–পুনর্মিলনও ঘটেছিল। বিয়েটা কিন্তু হয়নি। দোষটা ডেনটনেরই। ওই একটা দোষই কেবল ছিল বেচারির। পকেটে ছিল না। পয়সা। একুশ বছরে পা না-দেওয়া পর্যন্ত এলিজাবেথিটার ভাঁড়েও মা ভবানী, ওর তখন বয়স মোটে আঠারো। ওই যুগের রীতি অনুযায়ী একুশ বছর হলেই পাবে মায়ের সমস্ত বিষয়সম্পত্তি। ফলে, শিকেয় তোলা রয়েছে বিবাহ-পর্ব। দিবারাত্র ঘ্যানর ঘ্যানর করত এলিজাবেথিটা, তার মতো অসুখী আর কেউ নেই, কেউ বোঝে না, কেউ না, একমাত্র ডেনটন ছাড়া। ডেনটন কাছে না থাকলে দুচোখে অন্ধকার দেখে। ডেনটনও ঘ্যানর ঘ্যানর করে যেত একইভাবে, চৌপর দিনরাত কাছে পেতে চাইছে এলিজাবেথিটাকে, কিন্তু পাচ্ছে কই? দুজনের দুঃখ বিনিময় চলত দেখাসাক্ষাৎ হলেই।
উড়ুক্কু যন্ত্রযানের মঞ্চের ওপর রক্ষিত ছোট্ট আসনে বসে একদিন এইসব কথাই হচ্ছিল দুজনের মধ্যে। জায়গাটা লন্ডন শহরের পাঁচশো ফুট ওপরে। অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে আধুনিক লন্ডনকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর লন্ডন বাসিন্দাদের কাছে সে চিত্র তুলে ধরা বিলক্ষণ মুশকিলের ব্যাপার। ম্যামথ হোটেলশ্রেণি, স্ফটিক-প্রাসাদ, শহরজোড়া অতিকায় সৌধমালা কল্পনাতে আনাও কঠিন। অগুনতি ছাদের ওপর চব্বিশ ঘণ্টা বনবন করে ঘুরে চলেছে হাওয়ালের চাকা।
ডেনটন-এলিজাবেথিটার কিন্তু মনে হচ্ছে যেন বিশাল কারাগারে বন্দি রয়েছে দুজনে। আরও তিনটে বছর থাকতে হবে এই খাঁচায়–তারপর পাবে মুক্তি–বহুবার এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে দুজনের মধ্যে, এখনও চলছে একই দুঃখের চর্বিতচর্বণ। এই তিন-তিনটে বছর ঠায় বসে থাকা যে অতীব কষ্টকর, একেবারেই অসম্ভব এবং মনের ওপর চূড়ান্ত অত্যাচার, এ ব্যাপারে একমত হয়েছে দুজনেই। ডেনটন জানিয়েছে, তিন বছর ফুরানোর আগেই অক্কা না পায় দুজনে!
চোখে জল এসে গেল এলিজাবেথিটার। গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।
কিন্তু এহেন শহরে কপর্দকহীন অবস্থায় বিয়ে করাটাও তো একটা ভয়াবহ ব্যাপার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অবশ্য পাতায় ছাওয়া মেটে কুঁড়েঘরে দাম্পত্য জীবনযাপনের মতো সুখাবহ আর কিছুই ছিল না। পাখি নেচে বেড়াত গাছের ডালে ডালে, ফুলের সৌরভে মাতাল হয়ে থাকত বাতাস, অজস্র বর্ণ আচ্ছন্ন করত চিত্ত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সে দিন পালটাতে আরম্ভ করেছিল। গরিব মানুষরাও এখন শহরের নিচুতলার নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
তবে হ্যাঁ, ঊনবিংশ শতাব্দীতেও শহরের নিচুতলা ছিল আকাশ চন্দ্রাতপের ঠিক তলাতেই; মাটি, কাদা, বন্যার জল, ধোঁয়া, আবর্জনা, এই ছিল নিচুতলার চেহারা। পর্যাপ্ত জল পর্যন্ত পেত না। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর অঞ্চলেই ইতর প্রাণীর মতো গাদাগাদি অবস্থায় কোনওমতে দিন গুজরান করত নিচুতলার মানুষ। রোগের ডিপো ছিল এদের অঞ্চলটুকুই, সংক্রমণের এমন অনুকূল পরিবেশ পাত্তা পেত না বড়লোকদের পাড়ায়। দ্বাবিংশ শতাব্দীতে পালটে গেছে চিত্র। লন্ডন শহর এখন বহুতল নগরী, চারপাশে না ছড়িয়ে মাথা তুলে গেছে ওপরদিকে। যাদের পয়সা আছে, তারা থাকে ওপরতলায় খানদানি হোটেলকক্ষে; মেহনতি মানুষরা থাকে নিচের তলায় এবং মাটির তলাতেও।
মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলে লন্ডনেই ইস্ট এন্ড পাড়ার মেহনতি মানুষরা যেভাবে জীবনযাপন করে এসেছে, এখনও তার রদবদল ঘটেনি ঠিকই, কিন্তু কথ্য ভাষায় পরিবর্তন এসেছে বেশ বড় রকমের। এই নিচের তলাতেই কেটে যায় তাদের জন্ম থেকে মৃত্যু, ওপরতলায় ওঠে কদাচিৎকাজের সুযোগ পেলে। কষ্ট? অসুবিধে? দুর্ভোগ? গা সওয়া হয়ে গেছে। কেননা এই পরিবেশেই এদের অধিকাংশই যে মানুষ হয়েছে, কিন্তু ডেনটন আর এলিজাবেথিটার কাছে এই নারকীয় জীবনযাপন যে মৃত্যুর অধিক ভয়ংকর।
এলিজাবেথিটা কি ধারদেনা করতে পারে না? বিষয়সম্পত্তি হাতে এলে শোধ করে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু মুখ দিয়ে ডেনটন তা বার করতেও যে পারছে না। এলিজাবেথটা যদি তার অন্য অর্থ করে?
লন্ডন থেকে প্যারিসে যাওয়ার মতো গাড়ি ভাড়া নেই এলিজাবেথিটার হাতে। প্যারিস শহরটাও পৃথিবীর অন্যান্য শহরের মতো বড়লোকদের থাকার জায়গা। বড় খরচ। লন্ডন। শহরের মতোই সেখানে নিবাস রচনা অসম্ভব।
আহা রে! এর চাইতে অতীতের সেই দিনগুলোতেই যে ফিরে যাওয়া ছিল অনেক। ভালো। রোমান্টিক কল্পনারঙিন চোখে ঊনবিংশ শতাব্দীর হোয়াইট চ্যাপেলকে দেখবার প্রয়াস পেয়েছিল ডেনটন।