ভিক্টোরীয় যুগের লেখকরা দিবানিশি এই কাহিনিমালাই গেঁথে গেছেন তাঁদের গল্প উপন্যাসে–মানুষ স্রোতের মতো ধেয়ে যাচ্ছে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে। একই উপাখ্যান রচিত হয়েছে গ্রেট ব্রিটেনে, নিউ ইংল্যান্ডে, ইন্ডিয়ায় এবং চায়নায়–পুরাতনকে সরিয়ে দিয়ে নতুনের আবির্ভাব ঘটছে স্ফীতোদর বড় বড় শহরে। অপরিহার্য এই পরিবর্তন যে আসলে দ্রুত পরিবহণব্যবস্থার আবির্ভাবে, এ তথ্য উপলব্ধি করেছেন মাত্র কয়েকজনই– বালসুলভ প্রচেষ্টা চলেছে পৃথিবীজোড়া শহরমুখী চৌম্বক আকর্ষণ ঠেকিয়ে রাখার।
নব-ব্যবস্থার নিছক উষালগ্ন কিন্তু এই ঊনবিংশ শতাব্দী। শুরু তখুনি। নবযুগের বড় বড় শহরে অসুবিধে ছিল বীভৎস মাত্রায়। ধোঁয়ায় ভরপুর, কুয়াশায় অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর এবং কোলাহলময়। ভবন নির্মাণের নতুন পদ্ধতি, ঘর উষ্ণ রাখার নতুন ব্যবস্থা পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্তি দিল শহর সভ্যতাকে। ১৯০০ থেকে ২০০০-এর মধ্যে প্রগতি হল আরও দ্রুত; ২০০০ থেকে ২১০০-র মধ্যে মানবজাতির উন্নয়ন এমনই লাফ মেরে মেরে এগিয়ে গেল, এমনই অবিশ্বাস্য আবিষ্কারের পর আবিষ্কার ঘটতে লাগল যে, ভিক্টোরীয় যুগের সুব্যবস্থাকেও অবশেষে মনে হল যেন অলস প্রশান্ত জীবনের একটা অবিশ্বাস্য দূরদর্শন।
মানবজীবনটাকে চূড়ান্তভাবে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের পথে নিয়ে যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ রেলপথ প্রবর্তন। পরিবহণব্যবস্থার সন্ধিক্ষণ। ২০০০-এ একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল রেলপথ আর সড়ক। রেললাইন বঞ্চিত রেলপথগুলো ঝোপে ভরতি নালা হয়ে পড়ে রইল ভূপৃষ্ঠ জুড়ে। সড়কগুলো একদা নির্মিত হয়েছিল হাত দিয়ে দুরমুশ পিটিয়ে, বদখত লোহার রোলার চালিয়ে; চকমকি পাথর আর মাটি দিয়ে পেটাই অদ্ভুত সুপ্রাচীন সেইসব পথে ছড়ানো থাকত হরেকরকম আবর্জনা; লোহার অশ্বক্ষুর আর শকটচক্রে বিচিত্র পথ কেটে ফালাফালা হয়ে যেত কয়েক ইঞ্চি গভীর ক্ষত দগদগ করত রাস্তার সর্বত্র; ক্ষতবিক্ষত হতশ্রী এইসব পথ এখন লোপ পেয়েছে ধরাধাম থেকে–সে জায়গায় এসেছে এন্ডহ্যামাইট নামক একটি উপাদান দিয়ে নির্মিত পেটেন্ট করা পথ। পেটেন্ট যিনি নিয়েছিলেন–তাঁর নামই অমর হয়ে রয়েছে এন্ডহ্যামাইট নামটার মধ্যে। বিশ্ব ইতিহাসে যুগান্তর সৃষ্টি করবার মতো যে কটা আবিষ্কার আজ পর্যন্ত হয়েছে, ছাপাখানা আর স্টিম তার মধ্যে পুরোধা। এন্ডহ্যামাইট পড়ে এই পর্যায়ে।
আবিষ্কারকের নাম এন্ডহ্যাম। প্রথম যখন আবিষ্কার করেন উপাদানটা, গুরুত্বটা বুঝতে পারেননি। ভেবেছিলেন, ইন্ডিয়া-রবারের সস্তা বিকল্প উদ্ভাবিত হল বুঝি। সস্তা তো বটেই– টনপিছু দাম মোটে কয়েক শিলিং। কিন্তু একটা আবিষ্কার যে কত কাজে লাগতে পারে, তার ফিরিস্তি কি কেউ দিতে পারে? কাজেই স্বয়ং আবিষ্কারক এন্ডহ্যামাইটের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারলেও, পেরেছিলেন ওয়ামিং নামে এক ভদ্রলোক। শুধু গাড়ির টায়ারে নয়, রাস্তাঘাট বাঁধানোর কাজে বস্তুটাকে লাগানো গেলে যে পৃথিবীর খোলসটাকে মেজে-ঘষে ঝকঝকে তকতকে করে তোলা যাবে–এ ধারণা মাথায় আনতে পেরেছিলেন। ফলে, তাঁরই প্রচেষ্টা এবং সাংগঠনিক তৎপরতার সুফল হিসেবে ভূগোলকের সর্বত্র আবির্ভূত হল আধুনিক রাস্তার জটাজাল।
এক-একটা সড়ক লম্বালম্বিভাবে অনেক ভাগে ভাগ করা। দুদিকের কিনারা সংরক্ষিত শুধু সাইকেল আর সেইসব গাড়ির জন্যে, যাদের গতিবেগ ঘণ্টায় মাত্র পঁচিশ মাইলের বেশি নয়। তার গা ঘেঁষে ভেতরের দিক দিয়ে ধেয়ে যায় মোটরগাড়ি–গতিবেগ যাদের ঘণ্টায় একশো মাইল তো বটেই। একদম মাঝের অংশটুকু সংরক্ষিত রয়েছে অত্যন্ত বেগবান যন্ত্রযানদের জন্যে–গতিবেগ যাদের ঘণ্টায় দেড়শো মাইল কি তারও বেশি। এই ভবিষ্যদৃষ্টির জন্যে অবশ্য প্রচুর টিটকিরি হজম করতে হয়েছে ওয়ামিং বেচারিকে।
ওয়ামিং কিন্তু টলেননি। প্ল্যান অনুযায়ী সড়ক তো বানালেন। কিন্তু দশ-দশটা বছর বেবাক ফরসা হয়ে যাওয়ার পরেও একদম মাঝের অতিশয় বেগবান যন্ত্রযানদের জন্যে সংরক্ষিত অংশে ধুলোই জমা হয়ে গেল–গাড়ি আর চলল না। ওয়ামিং মারা যাওয়ার আগেই অবশ্য সবচেয়ে ভিড় দেখা গিয়েছিল একদম মাঝের অংশটুকুতেই। ঝড়ের বেগে বিশাল ধাতব কাঠামোর গাড়ি হরবখত ধেয়ে যেত সড়কের মাঝখান দিয়ে–বিরাট চাকাগুলোর ব্যাস বিশ থেকে তিরিশ ফুট তো বটেই। গতিবেগও বেড়ে চলল বছরে বছরে খুঁটিনাটি উন্নতিসাধনের মধ্যে দিয়ে–শেষকালে পৌঁছাল ঘণ্টায় দুশো মাইলে। গতিবেগের এই বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিপ্লব ঘটে গেল ক্রমবর্ধমান শহরগুলোর ক্ষেত্রেও। বিজ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগের ফলে ধুলো, ধোঁয়া, কুয়াশা, আবর্জনা অদৃশ্য হয়ে গেল (ভিক্টোরীয় যুগে যা ছিল শহরের সৌন্দর্য)। আগুনের বদলে এল বৈদ্যুতিক চুল্লি। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন হয়ে গেল–যে আগুন নিজের ধোঁয়া গিলে খেতে না পারবে, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। সদ্য-আবিষ্কৃত কাঁচজাতীয় একটা বস্তু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল শহরের সমস্ত পথঘাট, পাবলিক পার্ক আর বাজারহাট। লন্ডন শহরটার ওপর এই জাতীয় ছাদ নির্মাণ বলতে গেলে থেমে নেই আজও চলছে তো চলছেই। আকাশচুম্বী ইমারত নির্মাণ করার ব্যাপারে বেশ কিছু অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং মূর্খের মতো নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর থেকেই পালটে গেল লন্ডনের সুরতখানা–আগে যা ছিল চ্যাপটা, থ্যাবড়া থ্যাবড়া বাড়ি সমাকীর্ণ আদিম শহর–যে শহরের মধ্যে স্থাপত্যশিল্পের দৈন্যদশা প্রকট ছিল বড় বেশিভাবে–এখন সেই শহরেই মেঘলোককে চুম্বন দেওয়ার প্রয়াসে ধাঁ ধাঁ করে উঠে গেল লম্বা লম্বা সৌধ। দায়িত্ব বাড়ল মিউনিসিপ্যালের। জল, আলো আর পয়ঃপ্রণালীর সুবন্দোবস্ত করলেই শুধু চলবে না–বাতাস যাতায়াতের ব্যবস্থায় যেন ক্রটি না থাকে।