ইনি আমাকে চেনেন।
চেনো এঁকে?
না, কপালে হাত রেখে ক্লিষ্ট কণ্ঠে যেন শেখানো বুলি আওড়ে গিয়েছিল এলিজাবেথিটা, চিনি না… চিনি না… চিনি না।
কি-কিন্তু আমি যে ডেনটন। যার সঙ্গে কত কথা বলতে তুমি ফ্লায়িং স্টেজের নিচে বসে? মনে পড়ছে না? মনে পড়ছে না কবিতাগুলো–
না, না, না, চিনি না… চিনি না… আরও যেন কী আছে, কিন্তু মনে পড়ছে না… শুধু জানি… এঁকে আমি চিনি না– নিদারুণ অন্তর্দ্বন্দ্বে কালো হয়ে ওঠে এলিজাবেথিটার মুখচ্ছবি।
এইভাবেই চলেছিল কিছুক্ষণ। এলিজাবেথিটা চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারেনি তোতা পাখির মতো শুধু আওড়ে গেছে একটাই কথা–চিনি না… চিনি না… চিনি না ওঁকে। ক্ষিপ্তের মতো মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ডেনটন–কবিতার কথা, গানের কথা, প্রেমকাহিনির কথা।
কিন্তু বৃথাই। ক্লান্ত অবসন্ন এলিজাবেথিটাকে অবশেষে বাঁচিয়ে দিয়েছিল শ্যাপেরোন। ভাগিয়ে দিয়েছিল ডেনটনকে। পাগলের মতো চলমান মঞ্চ থেকে মঞ্চে লাফিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল ডেনটন। সেইদিকে নির্নিমেষে চেয়ে থেকে এলিজাবেথিটা শুধু জানতে চেয়েছিল, লোকটা কে? অনিমেষে তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে শ্যাপেরোন বলেছিল, বাজে লোক -মাথায় ছিট আছে। জীবনে দেখিনি। খামকা ও নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ো না।
এই ঘটনার পরেই সবুজ-হলদে পোশাক-পরা হিপনোটিস্টের কনসাল্টিং চেম্বারে আবির্ভূত হল একজন নয়া মক্কেল। তরুণ বয়স। উশকোখুশকো চুল। বিধ্বস্ত আকৃতি। উন্মাদের মতো শুধু বললে, ভুলতে চাই… ভুলিয়ে দিন… সব ভুলিয়ে দিন।
প্রশান্ত চোখে যুবকের পোশাক, আচরণ এবং মুখাবয়ব অবলোকন করে বললে হিপনোটিস্ট–ভুলে যাওয়ায় যন্ত্রণা অনেক কম। কিন্তু আমার দক্ষিণা যে বেশ চড়া।
ভুলতে যদি পারি…
হয়ে যাবে। আপনার নিজের ইচ্ছে যখন আছে… অসুবিধে হবে না। এর চাইতেও কঠিন কেস করেছি আমি। এই তো সেদিন একটি মেয়েকে সব ভুলিয়ে দিলাম– ভালোবাসার ব্যাপার ছিল।
হিপনোটিস্টের পাশে বসল তরুণ যুবা। জোর করে সংযত রাখল ছটফটানি। বললে অবরুদ্ধ কণ্ঠে, নাম তার এলিজাবেথটা স্বরেস।
কথাটা বলেছিল হিপনোটিস্টের চোখে চোখে চেয়ে। তাই দেখেছিল, নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় উথলে উঠল তার চোখে। বুঝেওছিল তৎক্ষণাৎ। ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠে কাঁধ খামচে ধরেছিল হিপনোটিস্টের। মুখে কথা সরেনি কিছুক্ষণ।
তারপরেই ফেটে পড়েছিল বিষম ক্রোধে। ফিরে পেতে চেয়েছিল এলিজাবেথিটাকে। আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ধস্তাধস্তি। দুজনের কেউই অ্যাথলিট নয়। কুস্তি করতে কেউই শেখেনি। এ যুগে ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শিত হয় কেবল বিশেষ উপলক্ষে। ব্যায়ামচর্চার রেওয়াজ আর নেই। কিন্তু দুজনের মধ্যে গায়ে জোর বেশি তরুণ যুবার। তাই অচিরেই আছড়ে ফেলল হিপনোটিস্টকে। কপালে চোট লাগায় জ্ঞান হারাল সম্মোহনের জাদুকর কিছুক্ষণের জন্যে। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখল, তার-ছিড়ে-আনা একটা ল্যাম্প বাগিয়ে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ডেনটন! খুনে চাহনি। খুনে কণ্ঠেই সে বললে, কথা না শুনলে প্রস্তর যুগের অস্ত্রচালনা করবে এখুনি। পাথরের হাতিয়ারের বদলে এই ল্যাম্প ছাতু করবে খুলি। অজ্ঞান থাকার সময়ে কাগজপত্র হাঁটকে পেয়েছে এলিজাবেথিটার ঠিকানা। ফোন করে দিয়েছে। শ্যাপেরোনকে নিয়ে সে আসছে এখুনি। এলেই যেন তাকে সম্মোহন করা হয়। ভাঁওতা দিতে হবে শ্যাপেরোনকে–সম্মোহন করা হচ্ছে মর্কটের মতো কদাকার ছোকরাটাকে এখুনি বিয়ে করার জন্যে–বললেই সে চুপ করে থাকবে। সম্মোহনের ঘোর এসে গেলেই ফিরিয়ে দিতে হবে এলিজাবেথিটার পূর্বস্মৃতি।
ক্ষীণকণ্ঠে আপত্তি জানিয়েছিল সম্মোহক ভদ্রলোক। আধুনিক মানবজাতির আচরণবিধি গ্রন্থে এ জাতীয় প্রস্তর-যুগীয় হামলাবাজির কথা কোথাও লেখা নেই। অটল থেকেছে ডেনটন। বেচাল দেখলেই ছাতু করবে খুলি। নিজে মরতে তার দ্বিধা নেই।
কিন্তু খুলির মায়া যে বড় মায়া–নির্দ্বিধায় জানিয়েছিল সম্মোহক। চিকিৎসকের সততা এখন শিকেয় তোলা থাকুক–কাকপক্ষীও জানবে না, এলিজাবেথিটা পূর্বস্মৃতি ফিরে পেল কী করে। ডেনটনের প্রতিও আক্রোশ মিলিয়ে যাবে দুদিনে। অনেকক্ষণ মেঝেতে বসে রয়েছে সম্মোহক, এখন উঠে বসলে হয় না? এলিজাবেথিটা যে এসে যাবে এখুনি।
২. বিজন শহরতলি
২। বিজন শহরতলি
দুনিয়াটা নাকি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যতটা পালটেছে, ততটা পালটায়নি বিগত পাঁচশো বছরের মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দী মানব-ইতিহাসে উষালগ্ন বিশাল নগরীর সূচনা ঘটে সেই শতাব্দী থেকেই–অবসান ঘটে সেকেলে গ্রামীণ জীবনের।
অগণন প্রজন্ম ধরে যেমনটি ঘটে এসেছে, ঠিক সেইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মানবজাতির অধিকাংশ বসবাস করত শহরতলিতে-গ্রাম অঞ্চলে। পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ থাকত ছোট ছোট শহর আর গ্রামে। সরাসরি নিযুক্ত ছিল কৃষিকর্মে অথবা কৃষিবিদের সহায়ক কাজকর্মে। পর্যটনের সুযোগ ঘটত কদাচিৎ-নিবাস রচনা করত কর্মস্থানের সন্নিকটে। কারণ দ্রুত ভ্রমণের উপযোগী যানবাহনের আবির্ভাব তখনও ঘটেনি। পর্যটনে বেরত মুষ্টিমেয় যে কজন, পদব্রজ, পালতোলা জাহাজ অথবা ঘোড়ায় টানা গাড়ির শরণ নিত। শেষোক্ত শকটটির গতিবেগ ছিল দিনে বড়জোর ষাট মাইল। ভাবতে পারেন? সারাদিনে মাত্র ষাট মাইল! মন্থরগতি সেই যুগে ক্কচিৎ দু-একটা শহর গজিয়ে উঠত লোকালয়ের ধারেকাছে বন্দর-শহর অথবা সরকারি দপ্তর-শহর হিসেবে। কিন্তু এক লাখ মানুষ থাকার মতো শহর আঙুলে গোনা যেত গোটা পৃথিবীতে! এই চিত্র ছিল ঊনবিংশ শতকের শুরুতে। শতাব্দীর শেষে রেলপথ, টেলিগ্রাফ, বাষ্পীয় পোত এবং জটিল কৃষিযন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর পালটে গেল চিত্র। আগেকার চিত্রে ফিরে যাওয়ার আর কোনও সম্ভাবনাই রইল না। শহরের মজা আর অগণন সুখ-সুবিধে রন্ধ্রে রন্ধ্রে শেকড় গেড়ে বসে গেল মানুষ জাতটার। রাতারাতি গজিয়ে উঠতে লাগল পেল্লায় পেল্লায় নগরী–বিশাল দোকান–শতসহস্র আরাম এবং বিরামের ব্যবস্থা। শুরু হয়ে গেল গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। শহরের দিকেই আকৃষ্ট হল মানবজাতি। দলে দলে মানুষ ধেয়ে গেল শহরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সুখের সন্ধানে। চাহিদা পড়ে গেল শ্রমজীবীদের-যন্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে। পল্লিপ্রকৃতিকে জবাই দিয়ে দ্রুত গড়ে উঠতে লাগল বৃহত্তর প্রমোদকেন্দ্র এবং শিল্পকেন্দ্র।