মনকে বিষয়ান্তরে নিবিষ্ট করে তিন-তিনটে দিন এইভাবে নিজের সঙ্গেই ভয়াবহ লড়াই করে গেল ডেনটন–নিষ্ঠুর সত্যটা প্রকট হল তারপর। কিন্তু এলিজাবেথিটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, এ ধারণা মাথায় আনতে পারল না কিছুতেই–নিশ্চয় অসুস্থ, অথবা হয়তো ধরাধামেই আর নেই। বড় কষ্টে গেল একটা সপ্তাহ। সাত-সাতটা দিন অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর সমগ্র সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করল এলিজাবেথিটা তার কাছে কতখানি ডেনটনের সমস্ত ভুবন জুড়ে রয়েছে যে মেয়েটি, তাকে খুঁজে বার করতে হবে যে করেই হোক–হয়তো নিষ্ফলে যাবে তল্লাশি–তবুও খুঁজতে হবে, খুঁজতে হবে–তাকে ছাড়া যে জীবন বৃথা।
পুঁজি কিছু ছিল। সেই ভরসাতেই চাকরি ছেড়ে দিল ডেনটন। এলিজাবেথিটা কোথায় থাকে, সে কোন স্তরের কী পরিবেশের মানুষ–কিছুই জানা নেই ডেনটনের। এলিজাবেথিটাই বলেনি মেয়েলি রোমান্সের পুলকে, সমাজের দুজনের দুই স্তরে স্থান, ডেনটন না-ই বা জানল সে বৃত্তান্ত। তাই যেদিকে দুচোখ যায়, বেরিয়ে পড়ল ডেনটন। লন্ডন শহরটা চিরকালই গোলকধাঁধার মতো। ছিল ভিক্টোরীয় আমলেও, রয়েছে এখনও। কিন্তু তখন লন্ডনে থাকত মোটে চল্লিশ লক্ষ মানুষ, দ্বাবিংশ শতাব্দীর লন্ডনে থাকে তিন কোটি মানুষ। বিষম উৎসাহে এই জনারণ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ডেনটন, খাওয়া ভুলে গিয়েছিল, ঘুমানোর কথা মনে থাকেনি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস খুঁজেছে প্রেয়সীকে, ক্লান্তি আর হতাশায় উবে গেছে প্রথমদিকের বিপুল উৎসাহ, দেহে-মনে নেমেছে অবসাদ, অধিক উত্তেজনা অপসৃত হওয়ার পর চিত্ত জুড়ে বসেছে অপরিসীম ক্রোধ। বহু মাস পর আশার ক্ষীণ প্রদীপটিও নিবে গেছে একসময়ে, তা সত্ত্বেও যন্ত্রবৎ খুঁজে গেছে এলিজাবেথিটাকে পথে পথে, গলিখুঁজিতে। যাকে দেখেছে, তারই মুখের দিকে অনিমেষে চেয়ে থেকেছে। লিফ্ট, প্যাসেজ, অন্তহীন পথে-বিপথে হন্যে হয়ে খুঁজেছে… খুঁজেছে… মানুষ-চাকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটিমাত্র মানুষকে…
দৈব সহায় হল একদিন। দেখা পেল এলিজাবেথিটার।
সেদিন ছিল উৎসবের দিন। ক্ষুধায় কাতর ছিল ডেনটন। ভেতরে ঢোকার দক্ষিণা গুনে দিয়ে ঢুকেছিল শহরের অন্যতম দানবাকার ভোজনকক্ষে। টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে নিছক অভ্যাসের বশে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছিল চেয়ারে আসীন প্রতিটি মুখ…।
দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আচম্বিতে স্থাণুর মতো, নড়ার শক্তি তিরোহিত হয়েছিল পদযুগল থেকে, দুই চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল কোটর থেকে, দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল অধরোষ্ঠ। মাত্র বিশ গজ দূরে বসে রয়েছে এলিজাবেথিটা, সটান চেয়ে রয়েছে তার দিকেই। কিন্তু এ কী চাহনি! পাথরের মূর্তির চোখেই যে এমন কঠোর, নির্ভাষ, নিরাবেগ চাহনি দেখা যায়। ডেনটনকে চিনতে পারার কোনও চিহ্নই নেই কুলিশ-কঠিন অক্ষিতারকায়।
মুহূর্তেক ডেনটনের পানে এহেন দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল এলিজাবেথিটা, পরক্ষণেই চেয়েছিল অন্যদিকে।
শুধু চাহনি দিয়ে যদি বিচার করতে হয়, তাহলে এই এলিজাবেথিটা ডেনটনের সেই এলিজাবেথিটা নয়। কিন্তু ডেনটনের এলিজাবেথিটাকে যে ডেনটন চেনে হাত দিয়ে, কানের পাশে দোলানো চূর্ণ-কুন্তল দিয়ে। মাথা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে কী সুন্দরভাবেই না দুলে ওঠে অলকগুচ্ছ। পাশে বসা মানুষটার কথা শুনে সংযত হেসে তার দিকে মুখ ফেরাল এই এলিজাবেথিটা। মানুষটাকে কটমট করে দেখল ডেনটন। খর্বকায় নির্বোধ আকৃতি। পরিচ্ছদ বুড়োটে সরীসৃপের মতন৷ মাথায় বাতাস-ফোলানো জোড়া শিং। এরই নাম বিনডন, এলিজাবেথিটার পিতৃদেবের মনোনীত পাত্র।
ক্ষণকাল দাঁড়িয়ে ছিল ডেনটন বিস্ফারিত চোখে–সমস্ত রক্ত নেমে গিয়েছিল মুখ থেকে। তারপরেই মনে হল, বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে। বসে পড়েছিল পাশের ছোট্ট টেবিলের সামনে। বসে ছিল কিন্তু এলিজাবেথিটার দিকে পিঠ ফিরিয়ে, চোখাচোখি তাকানোর সাহসও ছিল না। সামলে নেওয়ার পর আবার তাকিয়ে দেখেছিল, চেয়ার ছেড়ে উঠে। দাঁড়িয়েছে এলিজাবেথিটা আর বিনডন। উঠে দাঁড়িয়েছে তার বাবা আর শ্যাপেরোনও। যাওয়ার সময় হয়েছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে ছিল ডেনটন-নিশ্চল, নিথর, নীরব। আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়েছিল চার মূর্তি। সংবিৎ ফিরে পেয়েছিল ডেনটন। উঠে দাঁড়িয়ে ধাওয়া করেছিল পেছনে। চলমান মঞ্চের মোড়ে এসে দেখেছিল এলিজাবেথিটা আর শ্যাপেরোনকে। উধাও হয়েছে বিনডন আর স্বরেস।
ধৈর্য আর বাধ মানল না। এলিজাবেথিটার সঙ্গে এখুনি দুটো কথা না বললে যেন মৃত্যু হবে মনে হল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল দুজনের দিকে। ওরা বসে ছিল দুটো চেয়ারে। ডেনটন বসল পাশের চেয়ারে। বিষম উত্তেজনায় ক্ষিপ্তের মতো তখন থরথর করে কাঁপছে ডেনটনের সাদা মুখ।
হাত রেখেছিল এলিজাবেথিটার মণিবন্ধে–এলিজাবেথ, তুমি?
অকৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ ফিরিয়েছিল এলিজাবেথিটা। অজানা-অচেনা মানুষ গায়ে পড়ে আলাপ করতে এলে যুগে যুগে তরুণীরা যেভাবে ভয় পেয়েছে–সেই ভয় ছাড়া আর কিছুই প্রকটিত হল না দুই নয়নতারকায়।
এলিজাবেথ! উত্তেজনা-বিকৃত নিজের কণ্ঠস্বর নিজেই চিনতে পারেনি ডেনটন –এলিজাবেথ! কী সর্বনাশ! চিনতে পারছ না?
সভয়ে সরে বসেছিল এলিজাবেথিটা। উজ্জ্বল-চক্ষু ধূসর-কেশী শ্যাপেরোন ঝুঁকে বসে নিরীক্ষণ করেছিল ডেনটনকে–কী বললেন?