দিনের মধ্যভাগ কাটল জিমন্যাশিয়ামে। দুপুরের খাওয়া খেল অন্য দুটি মেয়ে আর সেই বয়স্কা রমণীর সঙ্গে, যেসব মেয়েকে একাই দেখাশোনা করে–যুবতী মেয়েদের সহচরী রাখার রেওয়াজ ভিক্টোরীয় যুগের মতো এ যুগেও রয়ে গেছে। যে মেয়েদের মা নেই অথবা যে মেয়েরা বিত্তশালী শ্রেণিভুক্ত, তাদের সহচরী থাকে এখনও। এককথায় এদের বলা হয় শ্যাপেরোন।
শ্যাপেরোন সেদিন একলা নয়। সঙ্গে রয়েছে একজন দর্শনার্থী। সাদা মুখ। চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। পরনে সবুজ আর হলদে রঙের পোশাক। কথার ধোকড়। বলার ভঙ্গিমাটাও চমৎকার। সাত-পাঁচ কথা বলতে বলতে শুরু করল ঐতিহাসিক রোমান্স। নতুন ধরনের প্রেমকাহিনি৷ এ যুগের একজন নামী গল্প-বলিয়ে সদ্য উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। কাহিনিটা অবশ্য ভিক্টোরীয় আমলের। কিন্তু একটা অভিনব আঙ্গিক সংযোজন করেছেন এ যুগের যশস্বী এই কথাশিল্পী। ভিক্টোরীয় যুগে প্রতিটি পরিচ্ছেদের মাথায় একটা শিরোনামা থাকত। উনি শিরোনামার অনুকরণে ছোট্ট ছোট্ট রংচঙে ভূমিকা জুড়ে দিয়ে প্রতিটি কাহিনিখণ্ডের আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছেন। সেকেলে কেতাব কাহিনির চাইতেও আঙ্গিকটি তাই চমকপ্রদ। হলুদ এবং সবুজ বর্ণের পোপাশাক-পরা পুরুষটিও মুখর হয়েছে আঙ্গিকের প্রশংসায়। ছোট্ট ছোট্ট এই বাক্যের নাকি তুলনা হয় না। এক ঝলকে মনের চোখে ভাসিয়ে তোলে বেপরোয়া দামাল যুগটাকে। মানুষ আর পশু তখন নোংরা রাস্তায় গায়ে গা দিয়ে চলত–তিলধারণের জায়গা থাকত না পথে। কোণে কোণে ওত পেতে থাকত মৃত্যু। জীবন তো একেই বলে! জীবনের মতো জীবন! অথচ পৃথিবীর বহু জায়গা তখনও ছিল অনাবিষ্কৃত। এ যুগে বিস্ময় জিনিসটা বলতে গেলে একেবারেই লোপ পেয়েছে। এ যুগের মানুষ বড় ছিমছাম কাটছাঁট ধরাবাঁধা জীবনযাপন করে। তাল কাটে না, সুর কাটে না। মানুষ জাতটার সাহস, সহিষ্ণুতা, আস্থা মিলিয়ে যেতে বসেছে একটু একটু করে–মহৎ কোনও গুণই আর থাকবে না দুদিন পরে–এত ঘড়ি ধরে নিয়ম মেনে ওজন করে চলার ফলে।
কথার ফুলঝুরি শুনে মেয়েরা তো মন্ত্রমুগ্ধ। অবাক হয়ে শুনছে গৌরবময় অতীতের কাহিনি। এই লন্ডন শহরেই কী বিপুল উচ্ছ্বাস-আনন্দ-প্রাণস্ফুর্তির বন্যায় ভেসে গেছে সে যুগের মানুষ। লন্ডন এখন আরও বড় শহর, আরও জটিল–দ্বাবিংশ শতাব্দীর এই লন্ডনের সঙ্গে তুলনা চলে না ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই ঘিঞ্জি নোংরা আধা-বর্বর লন্ডনের। এ যুগের লন্ডন থেকে পৃথিবীর যে কোনও অঞ্চলে যাওয়া এবং ফিরে আসা এখন কোনও সমস্যাই নয়। তা সত্ত্বেও বক্তার বাচনভঙ্গিমার ফলে মনে হচ্ছে, বড় একঘেয়ে কষ্টের জীবন এই লন্ডনের মানুষদের–এর চাইতে অনেক উচ্ছল, অনেক প্রাণবন্ত জীবন ছিল আদি লন্ডনের আদিম মানুষদের।
কথোপকথনে প্রথমে অংশ নেয়নি এলিজাবেথিটা। কিছুক্ষণ পরেই এমনই জমে উঠল বিষয়বস্তু যে, দু-চারটে মন্তব্য না করে পারল না। যদিও বেশ লাজুকভাবে। কিন্তু বক্তার যেন নজরই নেই তার দিকে। কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল… আপন মনে। বলে যাচ্ছে আরও একটা চিত্তবিনোদনের পন্থা। সদ্য আবিষ্কৃত পন্থা। সম্মোহন করে নাকি শ্রোতাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গৌরবোজ্জ্বল অতীতে। সম্মোহিত অবস্থায় শ্রোতার কানে কানে বলে দেওয়া হয়, এখন তুমি এসেছ প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হারিয়ে যাওয়া সেই যুগে। সম্মোহিত ব্যক্তি মনে করে, সে সত্যি সত্যিই রয়েছে পুরাকালের আনন্দ-অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে। বাস্তব জীবনের মতোই অতীতের রোমান্সে গা ভাসিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্যে, প্রেমক্রীড়ায় মত্ত থাকে মনের আনন্দে, ঘোর কেটে যাওয়ার পরেও কিন্তু মনে থাকে সবকিছুই… যেন সত্যি, সত্যি, সব সত্যি!
বহু বছর ধরে এই আনন্দ দেওয়ার পথ খুঁজেছি, বললে হিপনোটিস্ট, ব্যাপারটা আসলে স্বপ্ন, নকল স্বপ্ন। এতদিনে জেনেছি কীভাবে এই নকল স্বপ্ন মানুষের মনে অজস্র রং দিয়ে এঁকে দেওয়া যায়। ফলে, অভিজ্ঞতার বর্ণসুষমা, অ্যাডভেঞ্চারের পুনর্জাগরণ, ন্যক্কারজনক রেষারেষির মধ্যে থেকে পলায়ন… সবই এখন সম্ভব! অত্যাশ্চর্য এই আবিষ্কারের তুলনা হয় না!
সাগ্রহে শুধায় শ্যাপেরোন, আপনি জানেন নাকি কায়দাটা?
নিশ্চয়। কী স্বপ্ন চান, হুকুম দিয়েই দেখুন-না!
প্রথমে সম্মোহিত হল শ্যাপেরোন। আশ্চর্য স্বপ্ন নিয়ে আনন্দে আটখানা হল ঘোর কেটে যাবার পর।
উৎসাহ সঞ্চারিত হল অন্য মেয়েদের মধ্যেও। একে একে ধরা দিল হিপনোটিস্টের খপ্পরে। প্রেমমদির অতীতে ফিরে গিয়ে অবগাহন করে এল কৃত্রিম প্রেম-অভিজ্ঞতার ঝরনাধারায়। রোমান্স কে না চায়!
এলিজাবেথিটাকে কিন্তু কেউ সাধেনি। সে নিজেই এই আশ্চর্য মজার স্বাদ পেতে চেয়েছিল। তাই তাকে হিপনোটিস্ট নিয়ে গিয়েছিল স্বপ্নের জাদুপুরীতে–যেখানে গেলে আর নিজের কোনও স্বাধীনতা থাকে না, নিজের ইচ্ছেয় আর কিছু করা যায় না…
নষ্টামিটা সাঙ্গ হল এইভাবেই।
উড়ুক্কু যন্ত্রযানের মঞ্চের নিচে রাখা নিরিবিলি শান্তির চেয়ারটায় একদিন এসে বসল ডেনটন। কিন্তু এলিজাবেথিটাকে দেখতে পেল না। এল হতাশা, সেই সঙ্গে ক্রোধ। পরের দিনও এল না এলিজাবেথিটা, তার পরের দিনও নিপাত্তা। এবার ভয় পেল ডেনটন। ভয় ভুলে থাকার জন্যে লিখতে বসল চতুর্দশপদী সনেট কবিতা–এলিজাবেথিটা এলেই গছিয়ে দেওয়া যাবে হাতে…