চিঠি?
না, না, চিঠি নয়… ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে… কবিতা।
ভুরু তুলল হিপনোটিস্ট–ছোকরার সঙ্গে আপনার মেয়ের দেখা হল কীভাবে?
প্যারিস থেকে ফ্লায়িং মেশিনে এসে নামতে গিয়ে মেয়ে আমার হোঁচট খেয়ে পড়বি তো পড় এক্কেবারে ছোকরার দুহাতের মধ্যে। বাস! শুরু হয়ে গেল সেই থেকে।
আচ্ছা?
এবার বুঝেছেন, কেন ধড়ফড় করে মরছি? এ জিনিস বন্ধ করতেই হবে। হিপনোটিস্ট আমি নই–জানি না কী করতে হবে। কিন্তু আপনি
হিপনোটিজম তো আর ম্যাজিক নয়।
তা তো বটেই। কিন্তু তবুও
রাজি না থাকলে কাউকে হিপনোটাইজ করা যায় না। বিনডনকে বিয়ে করার যার ইচ্ছে নেই, সম্মোহিত হওয়ার ইচ্ছেও তার থাকবে না। কিন্তু একবার যদি সম্মোহিত হয়ে যায়– যেই করুক-না কেন–কাম ফতে হয়ে যাবে।
আপনিই তো পারেন
পারিই তো! মনের জোর একবার ভেঙে দিতে পারলেই হল। তারপর হুকুম দেওয়া যাবে, যাও ভুলে ছোকরাকে। অথবা দেখলেই যেন মাথা ঘোরে… নয়তো, অজ্ঞান হয়ে যেয়ো। ঘটবেও ঠিক তা-ই। সম্মোহনটা জবরদস্ত হওয়া চাই
তা তো বটেই! ভুলে মেরে দেওয়াটাই সবচাইতে ভালো—
কিন্তু সমস্যা তো হিপনোটাইজ করানোটা। আপনি বললে তো রাজিই হবে না।
বলে, হাতে মাথা রেখে কিছুক্ষণ ভেবে নিল হিপনোটিস্ট।
খাপছাড়া স্বরে বললেন স্বরেস, নিজের মেয়েকে সিধে করতে পারার মতো দুঃখ আর হয় না।
হিপনোটিস্ট বললে, আপনার মেয়ের নাম-ঠিকানা দিন। বিষয়টা সম্বন্ধে আরও কিছু খবর জানিয়ে রাখুন। ভালো কথা, এর মধ্যে টাকাকড়ির ব্যাপার আছে নাকি?
দ্বিধায় পড়লেন স্বরেস।
তা… ইয়ে… একটু আছে বইকী। ওর মায়ের টাকা। মোটা টাকা। পেটেন্ট রোড কোম্পানিতে খাটছে। এই টাকাটার জন্যেই তো ভাবনায় পড়েছি।
বুঝেছি, বলে স্বরেসকে জেরা শুরু করল হিপনোটিস্ট।
চলল অনেকক্ষণ।
ইতিমধ্যে এলিজাবেথিটা স্বরেস নামের মেয়েটি বসে আছে প্যারিস থেকে ফ্লায়িং মেশিন এসে নামে যে মঞ্চে, তার পাশের ওয়েটিং রুমে। এলিজাবেথিটা নামটা অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর উচ্চারণে দাঁড়ায় এলিজাবেথ। থ হয়ে গেছে থিটা। সে যাক গে। এলিজাবেথিটার পাশে বসে কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে তার ছিপছিপে চেহারার সুদর্শন প্রেমিক-কবিতাটা লিখেছে সেইদিনই সকালে মঞ্চে ডিউটি দেওয়ায় সময়ে। শেষ হল কবিতা। দুজনে মুখোমুখি যেন গভীর দুঃখী হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপরেই হু হু। করে আকাশ থেকে নেমে এল আমেরিকা থেকে আসা বিশাল উড়ুক্কু যন্ত্রটা।
প্রথমে ছোট্ট, লম্বাটে, নীলচে একখণ্ড বস্তুর মতো দেখা গেল ফ্লায়িং মেশিনটাকে সুদূর গগনে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ওপরে। বড় হয়ে উঠল দেখতে দেখতে। সুস্পষ্ট হল রং, ঝকঝকে সাদা। আরও কাছে আসতে আরও সাদা হল উড়ুক্কু যান। স্তরে স্তরে সাজানো পৃথক পালগুলো দেখা গেল স্পষ্ট। চওড়ায় প্রতিটা কয়েকশো ফুট। হিলহিলে বপুটা হল স্পষ্টতর। ফুটকি ফুটকি সারবন্দি প্যাসেঞ্জার চেয়ারগুলোও দেখা গেল সুস্পষ্ট। ভীমবেগে আকাশ থেকে খসে পড়া সত্ত্বেও নিচ থেকে মনে হল যেন ঠিকরে যাচ্ছে ঊর্ধ্বগগনের দিকে। শহরের ছাদের ওপর দিয়ে বিশাল ছায়া লাফ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছে মঞ্চের দিকে। যন্ত্রযানের আশপাশ দিয়ে শিস-দেওয়া শব্দে বাতাস ধেয়ে যাওয়ার আওয়াজ আছড়ে পড়ল কানের পরদায়। আর্তনাদ শোনা গেল সাইরেনের। মঞ্চে যারা রয়েছে, তীব্র তীক্ষ্ণ শব্দে হুঁশিয়ার করছে তাদের। আচম্বিতে ঝপ করে পড়ে গেল সাইরেনের বিকট আওয়াজ। পরিষ্কার হয়ে গেল আকাশ। স্নিগ্ধ চোখে এলিজাবেথিটা তাকালে পাশে বসা ডেনটনের পানে।
নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ হল ডেনটনের ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে। এ ভাষায় কথা বলা হত আদিম যুগে–বিশ্বসংসার যখন শৈশবাবস্থায়, তখন। নিরালায় ভাববিনিময়ের জন্যে এই ভাষাকেই বেছে নিয়েছে এলিজাবেথিটা আর ডেনটন। এ ভাষায় কথা বলে শুধু দুজনে মুখোমুখি বসে, দুজনের গণ্ডির বাইরে আর কেউ জানে না ভাষাটার শ্রুতিমাধুর্য। হোঁচট-খাওয়া আধো আধো ভাষায় ডেনটন ব্যক্ত করল তার মনোগত অভিপ্রায়। একদিন এলিজাবেথিটাকে নিয়ে সে-ও যাবে আকাশপথে সূর্যালোকিত আনন্দের দেশ জাপানে। চারদিকের বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠে ছিটকে ধেয়ে যাবে শূন্যপথে–আধখানা দুনিয়া পেরিয়ে দুজনে পৌঁছাবে রোদ্দুর ঝলমলে নিপ্পনে।
এ স্বপ্ন ভালো লাগে এলিজাবেথিটারও। কিন্তু ভয় পায় শূন্যপথে লাফ দিতে হবেখন– পরে হবে বলে প্রবোধ দিয়ে গেল ডেনটনকে–সমানে উৎসাহ জুগিয়ে গেল ডেনটন সেদিনের নাকি আর দেরি নেই। বলতে বলতে শোনা গেল তীব্র বাঁশির আওয়াজ-মঞ্চে ডিউটি দেওয়ার সংকেত। বিচ্ছিন্ন হল দুজনে–যেভাবে প্রেমিকযুগল বিচ্ছিন্ন হয়েছে যুগে যুগে হাজার হাজার বছর ধরে। করিডর বেয়ে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল এলিজাবেথিটা। লিফ্ট থেকে নেমে এল পরবর্তীকালের লন্ডন শহরের একটি রাস্তায়। কাঁচ দিয়ে বাঁধানো ঝলমলে চকমকে রাস্তা–রোদে-জলে যাতে রাস্তার দফারফা না হয়–তাই এই স্ফটিক আবরণ। কোথায় লাগে ইন্দ্রপুরীর রাজপথ। কেননা, স্ফটিকাবৃত অপরূপ এহেন পথের ওপর দিয়ে বিরামবিহীনভাবে সঞ্চরমাণ রয়েছে চলমান মঞ্চ। গোটা শহর জুড়ে রয়েছে এই মঞ্চ–যেখানে খুশি যাওয়া যাবে শুধু টুপ করে মঞ্চে উঠে বসলেই। এইরকমই একটা মঞ্চে উঠে বসে নারী হোটেলের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাল এলিজাবেথিটা। বিশ্বের যাবতীয় সেরা লেকচারারদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রয়েছে এখানকার প্রতিটা অ্যাপার্টমেন্টের। সেই মুহূর্তে কিন্তু এলিজাবেথিটার হৃদয় সূর্যালোকে মর্থিত থাকায় বিশ্বের সেরা লেকচারারদের প্রজ্ঞাও অতি-তুচ্ছ মনে হল সেই আলোর পশ্চাৎপটে।