তাই নাকি? হিপনোটিস্টদেরও কাজ থাকে?
প্রাতরাশ এসে গিয়েছিল টেবিলে। অম্বর রঙিন একটা জেলি প্লেটে তুলতে তুলতে হিপনোটিস্ট বললে, পসার তো বাড়ছে।
সর্বনাশ! আপনারা না থাকলে দেশ তাহলে অচল!
জেলির আঘ্রাণ নিতে নিতে বললে হিপনোটিস্ট, অতটা অপরিহার্য অবশ্য নই। আমাদের ছাড়াও হাজার হাজার বছর দিব্যি চলেছে। দুশো বছর আগে পর্যন্ত তো বটেই ব্যাবহারিক প্রয়োগ শুরু হয়েছে তো মোটে একশো বছর আগে থেকে। হাজার হাজার ডাক্তার অন্ধের মতো হাতড়েছে তার আগে-ভেড়ার পালের মতো ছুটেছে একই পুরানো চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে। নরক গুলজার করে রেখেছিল বলা যায়–মনের ডাক্তাররা কিন্তু ভুল করেনি–দু-চারজন হাতুড়ে ছাড়া।
জেলির দিকে মন দিল হিপনোটিস্ট।
স্বরিস বললেন, মানুষ জাতটার মস্তিষ্ক সে যুগে এতটা বিগড়ায়নি বলেই
মনের ওপর এরকম চাপ তো পড়েনি। হেসে-খেলে জীবন কেটে যেত। রেষারেষির বালাই ছিল না। খুব একটা বাড়াবাড়ি না হলে মানুষের মন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। বেগতিক দেখলে পাঠিয়ে দিত পাগলাগারদ নামে একটা জায়গায়।
নামটা শুনেছি। ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনিগুলোয় হামেশাই তো মেয়েদের উদ্ধার করে আনা হয় পাগলাগারদ বা ওই জাতীয় জায়গা থেকে। জঘন্য কাহিনি। লোকে শোনে কী করে বুঝি না।
আমি তো শুনি। ভালো লাগে। আধা-সভ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার মনকে ভরিয়ে তোলে। সে যুগের পুরুষরা ছিল বলিষ্ঠ, মেয়েরা সরল। এইসব নিয়েই লেখা চাঞ্চল্যকর গল্পে ভেসে যাওয়ার মতো আনন্দ আর নেই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অদ্ভুত সেই যুগের কত আশ্চর্য ছবি… লোহার রেললাইন, ধোঁয়া-ওঠা সেকেলে লোহার ট্রেন, ঘিঞ্জি ছোট্ট বাড়ি, ঘোড়ায় টানা গাড়ি। বই পড়ার নেশা আপনার নেই মনে হচ্ছে?
একেবারেই না। পড়েছি আধুনিক স্কুলে, ওসব সেকেলে বাজে ব্যাপারের মধ্যে মানুষ হইনি। ফোনোগ্রাফই যথেষ্ট আমার পক্ষে।
তা ঠিক, তা ঠিক, বলতে বলতে পরবর্তী খাদ্য অন্বেষণে ব্যস্ত হল হিপনোটিস্ট। টেনে নিল একটা ঘন নীল রঙের মিষ্টান্ন-হিপনোটিজম নিয়ে সে যুগে অবশ্য কল্পনা-টল্পনারও বালাই ছিল না। দুশো বছর পরে একশ্রেণির মানুষের পেশাই হবে স্মৃতিপটে ছাপ এঁকে দেওয়া, অন্যায্য ভাবাবেগকে দমন করা, অথবা অনেক কিছুই সম্মোহনের সাহায্যে ঘটিয়ে দেওয়া। অথচ এই ধরনের কথাবার্তা শুনলে আগে সবাই হেসেই উড়িয়ে দিত। খুব কম লোকই জানত, মেসমেরিজুমের ঘোরে যে হুকুম দেওয়া যায়, তা ঘোর কেটে গেলেও মেনে চলতে বাধ্য হয়। হুকুম দিয়ে মেসমেরিজুমের ঘোরে অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেওয়া যায়, ইচ্ছামতো কাজ করানো যায় ঘোর কেটে যাওয়ার পরেও–এত ব্যাপার কজন। জানত বলুন? অথচ অনেক অসম্ভব ব্যাপারও যে ঘটতে পারে–এমন কথা বলার মতো লোকও তো ছিল। যেমন ধরুন শুক্র গ্রহে যাওয়া।
হিপনোটিজমের খবরও তাহলে রাখত?
নিশ্চয়! কাজেও লাগিয়েছে-যন্ত্রণা না দিয়ে দাঁত তোলার ব্যাপারে এবং ওই জাতীয় কাজে! এই নীল জিনিসটা তো খাসা। কী দিয়ে তৈরি জানেন?
মোটেই না! খেতে কিন্তু চমৎকার। আরও একটু নিন।
আর-এক দফা প্রশস্তি নিয়ে নীরবে নীল বস্তুর রসাস্বাদন করে গেল হিপনোটিস্ট।
স্বরেস বললেন, ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনির আলোচনায় আবার আসা যাক। আপনার সঙ্গে দেখা করত চেয়েছিলাম কিন্তু এই ব্যাপারে। বলে শ্বাস নিলেন গভীরভাবে।
চোখে চোখ রাখল হিপনোটিস্ট। বিরাম রইল না কিন্তু খাওয়ার।
স্বরেস বললেন, আমার একটি মেয়ে আছে। সুশিক্ষা যত রকমের হতে পারে–সবই দিয়েছি তাকে। মামুলি লেকচারার দিয়ে নয়–টেলিফোন লেকচারার মারফত! সহবত, নাচ, কথাবার্তা, দর্শন, শিল্পসমালোচনা–কিছু বাদ দিইনি। ইচ্ছে ছিল আমারই এক বন্ধুকে বিয়ে করুক। চেনেন নিশ্চয়–লাইটিং কমিশনের বিনডন, সাদাসিধে ছোট্ট মানুষ, কিন্তু খাসা মানুষ, তাই না?
তা ঠিক। বয়স কত আপনার মেয়ের?
আঠারো।
বিপজ্জনক বয়স। তারপর?
তারপর আর কী! ঐতিহাসিক রোমান্স নিয়ে বড় বেশি মাতামাতি করছে। বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। জীবনদর্শন শিকেয় উঠেছে। যতসব লড়াকু সৈনিকদের রাবিশ ব্যাপার মাথায় ঢুকিয়ে বসে আছে। কী যেন নাম তাদের… ইট্রাসকান, তা-ই না?
ইজিপশিয়ান।
তা-ই হবে। তলোয়ার আর রিভলভার নিয়ে যাচ্ছেতাই সব ভয়ংকর মারদাঙ্গা ব্যাপার… রক্তারক্তি কাণ্ড… বীভৎস! বীভৎস! ফাঁদ পেতে টর্পেডো ধরা, বারুদ ফুটিয়ে স্প্যানিয়ার্ডদের উড়িয়ে দেওয়া, ননসেন্স অ্যাডভেঞ্চার! কোনও মানে হয়? এইসবের সঙ্গে আরও একটা বদ ব্যাপার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে বসে আছে… বিয়ে করবে ভালোবেসে। এদিকে বিনডন বেচারি…
বাধা দিয়ে বললে হিপনোটিস্ট, নতুন কিছু নয়। আগেও পেয়েছি এ জাতীয় কেস। অন্য ছোকরাটা কে বলুন তো?
হাল ছেড়ে দেওয়ার মুখভঙ্গিমা করলেন স্বরেস। জবাব দিতে গিয়ে যেন মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম হল বিষম লজ্জায়–প্যারিস থেকে উড়ুক্কু মেশিন এসে নামে যে মঞ্চে, সেইখানকার অতি সামান্য এক কর্মচারী। মেশিন থেকে নামতে সাহায্য করে, ফাইফরমাশ খাটে। রোমান্স গল্প-উপন্যাসে যেমনটি বলে, সেইরকমই দেখতে–মানে, মন্দ নয়– ভালোই। কাঁচা বয়স। মাথায় ছিট আছে। পুরাকালের বাতিল বিষয় মাথায় ঢুকিয়ে বসে আছে। যেমন ধরুন, লিখতে জানে, পড়তে পারে! ভাবতে পারেন? আমার মেয়েটিও সেই একই দলের। লিখতে জানে, পড়তেও পারে! দুজনে কথাবার্তা বলে টেলিফোনে নয়– আর পাঁচটা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হলে তা-ই করত–কিন্তু এরা মনের কথা লিখে ফেলে… কী যেন নাম জিনিসটার?